জিদান ট্যাক্টিক্যাল এনালাইসিস (পর্ব ২)
(আমরা যখন একজন মানুষকে যাচাই করব তখন আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, মানুষটি ভুল থেকে শিক্ষা নিচ্ছে কিনা। একটা মানুষ ভুল করবে এইতাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে একই ভুল দুইবার করছে কিনা সেইটাই দেখার বিষয়। আমরা এই পর্বে যাছাই করার চেষ্টা করব, জিদান কি ভুল থেকে শিক্ষা নে নাকি বারবার একই ভুল করছে?)
আনচলোত্তি চলে যাওয়ার পর জিদানই ডিরেক্ট পেরেজকে গিয়ে বলে,”আমি মাদ্রিদ কোচ হতে চাই।“ কিন্তু মাত্র এক সিজন ক্যাসিলাকে কোচিং করানো পেরেজের মনে তখনো সন্দেহ। পেরেজ বেনিতেজকে নিয়োগ দিল। ৬ মাসের মাথায় ভরাডুবি। গা বাঁচানোর জন্য পেরেজ জিদানকে ঠেলে দিল। জাস্ট কল্পনা করুন, আপনি যতই ভাল ট্যাকটেসিয়ান হোন না কেন এই রকম ইগোপূর্ণ একটা দলে মাঝামাঝি সময়ে ফেলে দেওয়া মানে আগুনে পরীক্ষা নেওয়া। জিদান হাসিমুখেই নিল। এসেই প্রথম যে কাজটা করল, এই উক্তক্ত ড্রেসিংরুম শান্ত করল। যার জন্য সবাই তাকে এখনো ম্যান ম্যানেজমেন্ট কোচ বলে মানে। কিন্তু ড্রেসিংরুম শান্ত করলে তো হবে না। ম্যাচ ও তো জিতা লাগবে।উক্তক্ত ড্রেসিংরুমে জিদান কোন পরীক্ষা নীরাক্ষায় যেতে চায় না। তাই এসেই সে তার গুরুর ৪-৩-৩ সিস্টেমে রাখল। এটল্যাটিকোর সাথে প্রথম পরীক্ষায় হেরে বসল ১-০ গোলে। হামেসকে এটাকিং মিডে রেখে। জিদান বুঝল, পিপল চয়েস টিম দিয়ে ম্যাচ জিতা যায় না। ম্যাচ জিততে লাগে ইফেক্টিভ প্লেয়ার।
আগের লেখাতে বলেছি, খেলোয়াড়ি জীবনে জিদানের সব থেকে একটা বড় গুণ ছিল মাঠে প্রবলেম সলভ করা। আর এইজন্যই তার পাশে থাকা এভারেজ প্লেয়ারগুলোও বেস্ট আউটপুট দিত তার সাথে খেলার সময়। নাও এখন সময় তার এই দক্ষতা কোচিং ক্যারিয়ারে কাজে লাগানোর। ম্যাকেলেলে চলে যাওয়ার সময় সবার থেকে সোচ্চার ছিল জিদান। এই গল্প সবার জানা।আর কেন সে এত বিরুদ্ধ ছিল এইটা সে প্রমাণ করল ক্যাসেকে এনে। ক্যাসে জিদানের ডার্টি কাজ গুলো করে দিত। ট্যাকল, বল উইন, কার্ড সব। জিদানের ক্লিয়ার আইডিয়া ছিল, তার থেকে সে কোন ভাল পাস পাবে না। কিন্তু তার থেকে যে ডার্টি ওয়ার্কটা পাবে সেইটাতে দল উপকৃত হবে। ক্যাসে আসার পর মদ্রিচ, ক্রুস এখন কোন টেনশন ছাড়াই এটাকিং এ খেলতে পারল কারণ তারা জানে তাদের পিছনে ডিফেন্স নিয়ে আর চিন্তে করা লাগবে না। এর পরেই রিয়াল হয়ে উঠল অপ্রতিরোধ্য। এই ক্যাসেমেরোকে দিয়ে সে বার্সার এমএসএন কে আইসোলেটেড করে রাখল। বার্সার অপ্রতিরোধ্য জয়রথকে থামাল তাও আবার ১০ জন ম্যান নিয়ে নু ক্যাম্পেই। সে ম্যাচে পিকের হেডে গোল খেলেও পুরো ম্যাচে জিদানের দল খেলায় ছিল। আর রন, বেনজু, বেলকে দিয়ে ডিরেক্ট কাউন্টার ট্যাকটিস সফল ছিল। বিশ্বাস না হলেও সত্য বিবিসিট্রয়ীকে দিয়ে জিদান প্রথম এল ক্ল্যাসিকো জিতল যেইটা তার আগে কোন কোচই করতে পারল না। আর এর মাধ্যমেই জিদান তার প্রথম পাজল সলভ করল। এই ট্যাকটিস দিয়েই সে এটল্যাটিকোর সাথে ফাইনাল খেলল । একটা সলিড ডিফেন্স লাইন দিয়ে জিতে নিল এটাল্যাটিকোর সাথে। শুধুমাত্র ক্যাসেকে মিডে এনে।হামেসের প্রয়োজনীয়তা বলতে গেলে তখনি শেষ। আর এই সময় রনকেও ফোর্স করা হত ডিফেন্স করতে।
দ্বিতীয় সিজন। হাফ সিজনে ইউসিএল জিতে জিদানের উপর প্রত্যাশ্যাও আকাশচুম্বী। আর জিদান এটল্যাটিকোর সাথে ম্যাচেই দেখেছে, তার খেলোয়াড়রা সময়ের সাথে সাথে কিভাবে ড্রেইন আউট হয়ে যাচ্ছিল। এখন সমস্যা হল, এইভাবে চলতে দিলে তার কী প্লেয়াররা সিজন শেষে গুরুতর অবস্থায় থাকবে। যেইটা এইবার মেসির খেলায় আমরা দেখেছি রোমার সাথে ম্যাচে। আবার, এইদিকে জিদান এখনো কাউন্টার এটাক বেসড টিম।
নাও আমরা একটু দেখে আসি আমাদের লীগগুলো কেমন। ফূটবল লীগের মধ্যে মোটামুটি ৫টা লীগ অনেক জনপ্রিয়।
ইংলিশ ফুটবলঃ হাই পেস, বক্স টু বক্স, এন্ড হেভিলি ফিজিক্যাল ব্যাটল।
জার্মান ফুটবলঃ ফোকাস ওন উইনিং, হাই স্ট্যামিনা, টিম পারফরম্যান্স মূল, নেভার গিভিং আপ মেন্টালিটি। অর্গানাইজ।
স্প্যানিশ ফুটবলঃ হাই পেস, ট্যাকটিক্যাল গেইম, মোস্ট অফ দ্যা টাইম প্রতিপক্ষকে ধুমড়ে দেওয়া ইন্ডিভিডিয়াল কী প্লেয়ার দ্বারা। লেস ফিজিক্যাল।(মাদ্রিদের রন, বার্সার মেসি)
ইটালীয়ান ফুটবলঃ কখনো হারা যাবে না। পুরোটাই টিম বেসড, স্ট্রং ট্যাকটিক্যাল ব্যাটল এন্ড ফোকাস অন সিংগেল প্লেয়ার হু ডিটার্মাইনস দা প্লে।(জুভের জিদান,দেল পিয়েরে, মাদ্রিদের ক্রুস,মদ্রিচ।)। স্পেস টাইট থাকবে। অপোনেন্ট কোন সুযোগ দেওয়া হবে না। স্লো এন্ড পিউর ডিফেন্সিভ মাইন্ডেড।(এইটার একটা মডিফাই ভার্সন করেছে মরিনহোর ইন্টার।)
ফ্রেঞ্চ ফুটবলঃ ইংলিশ লীগ বাদে বাকী সব কিছুই আছে। এদের ছোট টিম গুলো সীমিত রিসোর্সের মধ্যে প্রচুর ট্যাকটিক্যাল আর ট্যাকনিক্যাল ডিসিপ্লিন। প্রচুর ফিজিক্যাল ব্যাটল। এন্ড ডিফেন্সিভ মাইন্ডেড । বাট ডিফেন্সিভ ইন আ ওয়ে যাতে তারা বিল্ড আপ থ্রুতে অথবা ডিরেক্ট কাউন্টারে আপনাকে শেষ করে দিতে পারে।
মাদ্রিদের বর্তমান খেলা দেখলে বুঝা যায় এইটা পুরোটা এখন ইতালী, স্প্যানিশ আর ফ্রেঞ্চ ফুটবলের সংমিশ্রণ। সো কিভাবে সেইটা আসল? জিদান এই ৩টা লীগেই খেলেছে আর রন হচ্ছে মাদ্রিদের কী প্লেয়ার। আর স্প্যানিশ ফুটবল হচ্ছে আগেই বলেছি ইন্ডিভিডুয়াল নির্ভর। মাদ্রিদের সাকসেসের অধিকাংশ তাই নির্ভর করছে রনের উপর। তারমানে রনের উপর ওয়ার্কলোড ও কমানো লাগবে। এমন কোন সিস্টেম ডেভেলাপ করা লাগবে যেইটা আমার কী প্লেয়ারকে ওয়ার্ক লোড কমাবে মাঠে আবার আমাদের ডিফেন্সকেও স্ট্যাবিলিটি দিবে। সলিউশন আবার ওল্ড তুরিন। লিপ্পির স্কুল।
ESPN এ একটা ডকুমেন্টরী দেখছিলাম লিপ্পির ক্যারিয়ার নিয়ে। সেখানে ইন্টারভিউ শেষে প্রতিবেদক বলছিল, লিপ্পি অসাধারণ একজন কোচ। ৬টা লীগ +১টা ইউরোপিয়ান টাইটেল আর একটা বিশ্বকাপ জিতা কোচের ট্যাকটিস নিয়ে কেন এত শরগোল হয় না তা একটা বিষ্ময় বটে। লিপ্পি সাচ্চির আগের ইটালি কেও জানত। তাকে বলা যায়, সাচ্চি আর অল্ড গিকো এটালিনার সংমিশ্রণ। গিকো এটালিনা হল ইটালীর সব থেকে প্রাচীন আর পপুলার ট্যাকটিস। যাকে আমরা বর্তমানে জোনাল মার্কিং বলে জানি। আইডিয়াটা প্রথম আনে, জুভের লিজেন্ড ট্রাপোত্তি। এই জোনাল ট্যাকটিস দিয়ে প্রায় ১০ বছরের মত রাজত্ব করেছিল বিশ্বকাপ সহ যত ধরণের ট্রফি আছে সব কিছু জিতে নিয়েছিল ট্রাপোত্তি। সাচ্চির মিলান ছিল এইটার এডাভান্স ভার্সন। জোনাল কভার দেওয়ার জন্য দুইজনকে রাখত। (জোনাল মার্কিং হল আমি যদি স্পেস ফেলে আসি দলের অন্য কোন প্লেয়ার স্পেসটা ব্যবহার করে শেইপটা মেইনটেইন করবে।শেষ ম্যাচে মার্সেলোর ফেলে আসা স্পেস কভার দেওয়ার কথা ছিল ক্যাসে অথবা ক্রুসের। কিন্তু তারা কেউ দে নি।)আর এটাকিং এর জন্য তারা বেছে নিয়েছিল ক্রুইফের পজিশনাল ট্যাকটিস(সাচ্চির মিলান নিয়ে অনেক লেখা আছে। তাই আর ওই দিকে গেলাম না।) সাচ্চির নিজেদের হাফে কাউন্টার প্রেস এখনো পেপ, ক্লপরা ব্যবহার করে। সাচ্চি একবার বলেছিল
The only way you can build a side is by getting players who speak the same language and can play a team game. You can’t achieve anything on your own, and if you do, it doesn’t last long.
এই উক্তিটি পড়ার পর প্রথমেই বর্তমান কালে কোন দলের কথা ভেসে আসে? হ্যা মাদ্রিদ। মেসিকে যেখানে একা খেলা লাগে ক্লপ যেখানে ফ্রন্ট থ্রির উপর নির্ভরশীল, রিয়ালের সে সমস্যা নেই। এইজন্য রনের কাজ এইখানে নির্দিষ্ট।
লিপ্পি মিলানের ফল ডাউনটা দেখেছিল।তাই সে মডার্ণ আর ট্রেডিশনের সংমিশ্রণ ঘটাল তার খেলায়। লিপ্পির টিম জানত, কিভাবে ম্যান মার্ক করতে হয়(ইটালীর ‘৬০-৭০ সব থেকে পপুলার ট্যাকটিস) তারা এইটাও জানত কখন জোনাল ট্যাকটিস ব্যবহার করতে হবে। লিপ্পির টিম পজিশনাল বেসড টিমের সাথে কাউন্টার এটাক সিস্টেম ব্যবহার করত আবার দরকার পড়লে টিম ভেদে তারা কাউন্টার প্রেস করত। লিপ্পির একাদশ কখনো ফিক্স ছিল না। হ্যা জিদানের মত। ইভেন বিশ্ব্বকাপের মত ম্যাচেও সে কখনো ফিক্স একাদশ নিয়ে খেলেনি। তাদের প্লেয়াররা সারাক্ষণ ট্যাকটিস আর প্রতিপক্ষ নিয়ে আলোচনাতে ব্যস্ত থাকত। প্রতিটা প্লেয়ার বিপরীত টিমকে এনালাইজ করত আর সে সাপেক্ষে সবার মতামতের ভিত্তিতে এবং প্রতিপক্ষের উইক জোনের উপর একাদশ গঠন করা হত। লিপ্পি যখন জুভের দায়িত্ব নে। তখন ক্রান্তিকাল চলছিল তুরিনে। ট্রাপোত্তির পর ১০ বছর কোন শিরোপা নেই। জুভেতে এসে প্রথম সিজনে লীগ জিতল আর দ্বিতীয় সিজনে আনল জিদানকে। তাও আবার কাকে বেচে? বাজ্জিও। হ্যা স্টাইকার বেচে প্লেমেকার। তার থেকেও বড় কথা স্টার প্লেয়ার। লিপ্পি জানত, তুরিনে এখন তারুণ্যের হাওয়া দরকার। লিপ্পি খেলা বিল্ড করত প্রেস করে, জিদান অথবা দেল পিয়েরে প্রেস করত। আর বাকীরা পাসিং লাইন বন্ধ করে দিত। সেইম প্রিন্সিপাল জিদান মাদ্রিদে গত সিজনে ইমপ্লিমেন্ট করেছে। যখন লিপ্পি ইটালীর দায়িত্ব নে, তখন ইটালীর ফূটবলে ক্রান্তিকাল চলছে। ম্যাচ ফিক্সিং ক্যালেংকারীতে জর্জিত ইতালী। কোন প্লেয়ারের তখন খেলার প্রতি আগ্রহ নেই। এর মধ্যে লিপ্পি ঠিক জিদানের মত উক্তক্ত ড্রেসিংরুম শান্ত করল।পরে তো বিশ্বকাপই জিতে গেল। সে সময়ের অধিনায়ক ক্যানেভারো কথাতে বুঝা যায় ওই সময়ের অবস্থা
The 2006 group took two years to build – enough time to understand that when one of you is in trouble you can always get support from team-mates, and when you need someone you’ll always have them at your side. And you might not believe it, but in those 40 days [at the 2006 World Cup] we had a lot of fun too
একটা টিম গড়ে তুলতে দুই বছর সময় নিয়েছিল লিপ্পি সাথে তাদের মধ্যে আন্ডারস্টান্ডিং এর ব্যাপারও গড়ে তুলেছিল। তার থেকেও বড় কথা, ট্রাপোত্তি, সাচ্চি, লিপ্পি কখনো ট্রান্সফার মার্কেটে একটিভ ছিল না। এরা প্রয়োজন বাদে কখনোই প্লেয়ার কিনত না। লিপ্পির দর্শন ছিল এন্টি ক্রুইফ।
ফিরে আসি আবার মাদ্রিদে, রনের সমস্যা সমাধানের জন্য জিদানকে ঝুঁকি নিতেই হবে সেইটা রনের সাথে সমস্যা হলেও।জিদান las palmas ম্যাচে রনকে সাবস্টিউট করাল। আর আমরা সবাই দেখলাম রন কি পরিমান রেগে গিয়েছিল রন চলে যাওয়ার পর মাদ্রিদ ড্র করল। কিন্তু ড্রেসিংরুম গিয়ে জিদান তাকে বুঝাতে সমর্থ হল।মাঠে হারলেও এনাদার উইন ফর জিদান যেইটা ভবিষ্যতে কাজে দিবে আজকে থেকে কয়েক মাস পর। এইদিকে, সিজনের শুরু থেকেই লীগে ভাল অবস্থানে মাদ্রিদ। বেসিক প্রিন্সপাল ফলো করে জিদান ম্যাচ বের করে আনলেও কনভিন্সিং জয় একটাও জিল না। যখন লীগ মাঝামাঝিতে, জিদান ঠিক করল সে আবার রিস্ক নিবে। তার নিউ আইডিয়া স্কোয়াড রোটেশন। এই রোটেশন পলিসি উপকার দিল পুরো স্কোয়াডকে। প্লেয়ারদের ড্রেইন আউট সমস্যা সমাধানের জন্য সে সিজনের শুরুতেই নতুন ট্রেইনার নিয়োগ দিয়েছে। এর পাশাপাশি তাদের উপর ম্যাচ প্রেশারও কমিয়ে এনেছে। জিদান এখন তার পজিশনাল আইডিয়া ইমপ্লিমেন্ট করতে পারবে। আর রোটেড স্কোয়াডকে তার নিউ পজিশনাল আইডিয়ার সাথে খেলাতে লাগল। মেইন টিম খেলতে লাগল কাউন্টারে। ওই সময় মেইন টিম থেকে রিজার্ভ টিম বেশি গোল দিত। সবাই হাংরি+ ফোকাস। রিজার্ভ টিম খেলত ৪-৪-২ পজিশনে। হ্যা সাচ্চির মিলানও সেইম ফরমেশনে খেলত। ৩ জন সেন্টারব্যাক, ১ টা সেন্ট্রাল মিড, ১টা ডিফেন্সিভ মিড, ১জন সাইড মিড, ১ জন শ্যাডো স্টাইকার হু বেসিক্যাল হেল্প ইন বিল্ড আপ প্লে নো ইন্টেনশন অফ গোল বাট এট্রাক্ট ডিফেন্ডার এ লট(বেঞ্জু), আর একজন সেন্টার ফরওয়ার্ড। আর একজন উইংব্যাক যে এটাকিং এ সাহায্য করবে। মাদ্রিদে জিদান এই ফরমেশনকে একটু মোডিফাই করল। সে দুইটা ফুলব্যাককেই উপরে উঠার পারমিশন দিল আর ক্রুস অথবা মদ্রিচ কে অবস্থা বুঝে নিচে ডিফেন্সিভ স্টাবিলিটির জন্য রেখে দিল। বাকী পুরো কনসেপ্ট সেইম।
কিন্তু মেইন টিমে পজিশনাল আইডিয়া সে ইমপ্লমেন্ট করতে পারছিল না কারণ এরা পিউর কাউন্টার বেসড টিম। কথায় বলে,”ভাগ্য সাহসীদের পক্ষে।” কাকাতলীয়ভাবে, এটল্যাটিকোর সাথে ম্যাচের আগে ইঞ্জুরি হল বেল। এটল্যাটিকোর ডিফেন্স ভাঙ্গার জন্য পজিশনাল ফুটবলই বেস্ট। জিদান এখন তার সেকেন্ড তুরুপের তাস ব্যবহার করবে। ইস্কো কে মিডে এনে এ ফ্লোটিং ডায়মন্ড ফরমেশন বানাল। ৪-৩-৩। আর এইটা দিয়ে ম্যাচ জিতে নিল ৩-০ গোলে। সেকেন্ড পাজল সলভড। বছর শেষে জিতে নিল লীগ ইউসিএল সহ ৫টা শিরোপা। প্রথমবারের মত মডার্ণ ইউসিএলে পর পর দুইবার শিরোপা। সাচ্চির মিলান, থ্রাপোত্তির জুভেও কিংবা লিপ্পি সেইম কাজ করেছিল এসেই শিরোপার পর শিরোপা জিততে থাকল।
![image] (https://image.ibb.co/hG1egd/31671378_418634878599167_3045217106619531264_n.jpg)
এইবার একটু থিউরীটিক্যাল কনসেপ্টে আশা যাক, এই পার্টটা একটু বোরিং হবে।কিন্তু এইটা না জানলে জিদানকে বোঝাও সম্ভব হবে না।ফুটবল খেলার বেসিক ৩টা রুল আছে। এইগুলো হল POSSESSION, PROGRESSION, FINALIZATION. এই ৩টা রুল স্থান, কাল, পাত্র ভেদে সব সময় কাজ করবে।
আমরা এখন এখব জিদান কিভাবে এইগুলো নিজের টিমে ইমপ্লিমেন্ট করেছে।
পজেশনঃ
জিদানের টিম প্রতিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে ২০-২৫ মিটার দূরত্বে পজিশন হোল্ড করে রাখে। মাদ্রিদের খেলা দেখলে বুঝতে পারবেন। তারা প্রতিপক্ষের এটাকিং প্রান্তে গিয়ে ব্যাক পাস,আর এই উইং থেকে ওই উইং শুধু বল রোটেড করতে থাকে। আর এইভাবে তারা স্পেস খুজে নিতে থাকে। যদি না পাই, স্টাইকাররা ডিপে নেমে আসে ফলে তাদের পিছনে ঠিকই স্পেস ক্রিয়েট হয়। প্রতিটা প্লেয়ারই তখন সামনে মুভ করতে থাকে স্লো এন্ড প্যাশনটলি। ১ মিটার ১ মিটার করে তারা সামনের স্পেস কভার করতে থাকে। জিদানের এই পজিশন সাকসেস ডিপেন্ড করে ক্রুস মদ্রিচ পিভোট। তারা হাফস্পেস কভার দে এন্ড দে হেভ এটাকিং ব্রেইনস। হাফ স্পেস কভার দেওয়ার কারণ হল যাতে তারা কাউন্টার এটাক থামানো যায়। আর এই কারণেই মদ্রিচ, ক্রুস প্রেস ফেইল করলে মাদ্রিদ পিছনে ভুলনারেবল হয়ে যায়। ক্রুস হচ্ছে বেস্ট পাসার। মদ্রিচ হচ্ছে ড্রিবলার।ওয়ান টু ওয়ানে বেস্ট। আর এই সময় দুই ফুলব্যাক এটাকিং এ যোগ দে। ফরমেশন টা দাঁড়ায়, ৩-৩-৪ এ। পর্যাপ্ত স্পেস না পেলে বেঞ্জু নিচে নেমে আসে সাহায্য করতে বিল্ড আপে। আমাদের এই পর্যন্ত বেস্ট পজিশনে সেনা মোতায়েন করা শেষ।
প্রোগ্রেশনঃ
এখন আমাদের বল সামনে খেলানো লাগবে। আগেই বলেছি, মাদ্রিদ সামনে স্পেস না পাওয়া পর্যন্ত বল রোটেড করতেই থাকে। যদি না পায়, শুরু এটাকিং গেইম। আমাদের টিমের বেস্ট ড্রিবলার মার্সেলো। ১ বনাম ১ এ আমাদের সেরা প্লেয়ার। যে নিশ্চিত ভাবে বল সামনে ক্যারি করতে পারবে। আর তাকে সার্পোট দেওয়ার জন্য থাকে ইস্কো। ইস্কো এইখানে খুবই ক্রুশিয়াল রোল প্লে করবে। সে এই উইং থেকে ওই উইং দৌড়ে যায় শুধুমাত্র উইং এ নিউম্যারিক্যাল সুপিওরিটি দেওয়ার জন্য। এর পরেও স্পেস খুজে না পেলে বেঞ্জু ড্রাগ আউট করা শুরু করে ডিফেন্ডারদের। আর এই প্রোগেশনে জিদানের মেইন উইপন হল বেঞ্জু। বেঞ্জু নিজেকে এমন পজিশনে দাঁড় করায় তাতে দুই সিবিই কনফিউজড থাকে কে থাকে মার্ক করবে। আর ম্যান মার্কিং অবস্থায় থাকলে। সে রনের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় থাকে ফলে প্রতিপক্ষের ডিফেন্সিভ শেইপটা নষ্ট হয়ে যায়।বেঞ্জুর মেইন কাজ হল একচুয়েলি বিল্ড আপ প্লে+প্রতিপক্ষের শেইপ নষ্ট করা। আর এইজন্য দরকার বুদ্ধিমত্তা। বেনজুর সেইটা আছে। সে তার প্লেয়ারদের পজিশন সম্পর্কে খুবই সচেতন। যারা মাদ্রিদের খেলা ফলো করে তারা দেখবেন, সে দলে থাকলে পাসিং কম্বিনেশনটা ভাল হয়, এন্ড বেসিক্যালি সে একটা এক্সটা মিড হিসেবে খেলে। জিদান তার থেকে কোন গোলের আশা করে না। গোল করতে পারলে ভাল না করলেও সমস্যা নেই। আর বেঞ্জু অলয়েজ ডিফেন্ডার সামনে বল শিল্ড করে রাখে। আপনি বেঞ্জুকে বল দিয়ে নিশ্চিত থাকতে পারেন সে বলটা আপনার জন্য হোল্ড করে রাখবে যেমনটা আপনি নিশ্চিত সে গোল দিবে না।
ফাইনালাজাইশনঃ
প্রথম ২টা কাজ মোটামুটি সব টিমই করতে পারে কিন্তু আপনার পুরো প্রসেসের সাকসেস ডিপেন্ড করে এর ফাইনালাজেশনের উপর। আর এইখানে জিদানের তৃতীয় পাজল সলভ। পারফেক্ট ফিনিশিং ডিপেন্ড করে টাইমিং এর উপর। আর টাইমিং টা আসে স্পেস ক্রিয়েট করার পর আপনি ভেবে চিনতে পাস দিবেন। প্রোগেশন স্টেজে তারা ডিবক্সের সামনে ২০ মিটার স্পেস খুজে নিতে সক্ষম হল। এখন ধরে নিলাম প্রতিপক্ষ প্রচুর ডিফেন্সিভ মাইন্ডেড। তখন ২০ মিটার দূর থেকেই আসে ওয়েটেড লফটেড ক্রস ফ্রম মার্সেলো, ক্রুস অথবা কার্ভা। আর রিবাউণ্ডে মদ্রিচ, ক্রুস অথবা ক্যাসের লং রেঞ্জ এবিলিটি। ব্যাপারটা অনেকটা হয়ে যায় তখন ফ্রিকিক নেওয়ার মত। জিদানের ২৮-৩৫% গোল ক্রসে। এইটা পিউর স্কিল। বর্তমানে কোন দল রিয়াল বাদে এত সুন্দর করে স্পেস ক্রিয়েট করতে পারে না জাস্ট ফুটবল বেসিক দিয়ে। জিদানের আমাদেরকে ফুটবলের আদি লেসনে নিয়ে গেল। অপোনেন্ট প্রেশার এভজর্ভ করতেই থাকে। ক্রসিং প্রেশার। মাঝে মাঝে রামোসকে সামনে পাঠানো হয় এই এয়ার ব্যাটল উইনের জন্য।প্রতিপক্ষকে প্রতিটা সেকেন্ড কনসার্ন থাকতে হয়। ফার্স্ট হাফে ট্যাকল দেওয়া গেলেও,সেকেন্ড হাফে সময়ের সাথে সাথে মনোযোগ হারিয়ে যায়। আর এইভাবে ভাগ্যের জোরে জিতে আসে রিয়াল প্রতিবার।
সিজনের শুরুতে প্রবলেম ছিল রনের ইগো, সিনিয়রদের ড্রেইন আউট, আর ক্লিয়ার এটাকিং আইডিয়া। সিজন শেষে সব প্রবলেম সলভড। সাম্রাজ্য গড়তে হলে ট্রফি নয়, ভিতরের সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে হয়। অন্য কোচ হলে এই সব জায়গায় প্লেয়ার এনে এনে সমস্যা করত। জিদান এমন না। সে হারিয়ে যাওয়া ইতালীর ওল্ড স্কুলের প্রতিনিধি।
মাদ্রিদের দ্বিতীয় সিজন, মোটামুটি সব ট্যাকটিক্যাল প্রবলেম সলভ। তার টিম এখন কাউন্টার এটাকও খেলতে পারে আবার পোজেশনাল ফুটবলও। জিদানের আইডিয়া হল এখন সিম্পল, প্রথম হাফে পোজেশনাল খেলে প্রেশার এবজর্ব সেকেন্ড হাফে কাউন্টার। কিন্তু এর মধ্যে চলে গেলে মোরাতা আর হামেস। জিদান এখনো এইগুলো নিয়ে চিন্তিত না। তার হাতে এখনো ২৩ টা প্লেয়ার আছে। কিন্তু বাধ সাধল স্প্যানিশ টিমগুলো। বিশেষ করে লেভান্তে। ম্যাচ শুরুর আগে কোচ জানিয়ে দিল, তারা মাদ্রিদকে ভয় পাই না। আগেই বলেছি, স্প্যানিশ টিমগুলো ট্যাকটিক্যাল+ট্যাকনিক্যাল হয়। মাদ্রিদের পোজেহসন বেসড ফুটবলকে রুখে দেওয়ার জন্য সে দাঁড় করাল ৪-৫-১ পিউর কাউন্টার এটাকিং স্ট্র্যাটেজি। লোপেজ জানত, ইটালীর ডিফেন্সিভ অর্গানাইজেশন সাকসেস্ফুল ছিল কারণ ইটালীর প্লেয়াররা মানসিকভাবে এমন। বাট স্প্যানিশ ফুটবল এমন না। দে লাভ ওপেন ফুটবল।আর এর থ্রুতে ১-০ গোলে জিতে গেল লেভান্তে। পরবর্তীতে সবাই রিয়ালের বিপরীতে এই ফরমশনে খেলায় শুরু করল। জিদান পড়ল আবার বিপদে। এখন প্রতিপক্ষ যখন কাউন্টার করে তখন প্রতিপক্ষেরও স্পেস পড়ে থাকে অনেক। কিন্তু এই সুযোগ রিয়াল পাচ্ছিল না ইস্কো, ক্যাসের বল স্লো টেম্পোর কারনে। ইস্কো কখনোই আউট ফর্ম ছিল না। আর সেইটা জিদান জানত। জিদানের আবার কাছ করা শুরু। সে দেখল মাদ্রিদ যখন ৪-১-৪-১ ডিফেন্স করে ক্যাসের দুই পাশে প্রচুর স্পেস থাকে। আর এই সমস্যা সমাধানের জন্য সে তার ৪-৪-২ কে আবার মডিফাই করল। এই সিজনে ৪-৪-২ ফ্ল্যাট। ভাসকেস, এসেন্সিও পেস এন্ড ডিফেন্সিভ ডিউটি ফরমেশনে স্টাবিলিটি আনল। আর এই জন্য বেলকে জায়গা হারাতে হল।এর মানে এই না যে, বেল তার পরিকল্পনা থেকে বাদ। বরং এইটা বলা যায়, ভাস্কেস সময়, সিচুয়েশন অনুযায়ী অনেক বেশি রিয়েলস্টিক। হয়ত পরবর্তী সিজনে এই ফরমেশনও কেউ ব্রেক করবে। তবে আমি এতটুকু বিশ্বাস করি, জিদানও তার ফরমেশন সময়ের সাথে এডাপ্ট করে নিবে। কিন্তু এতটুকু সময় আমাদের তাকে দিতে হবে। আর প্লেয়াররা কেন এত খুশি? কারণ আপনি নিজেই দেখছেন, এইটা এখন মাদ্রিদ ড্রেসিং রুমে ফান হয়ে দাড়িয়েছে। তারা জানে তাদের নিজেদের স্কিলের দিকে ফোকাস করলে হবে। ম্যাচ নিয়ে টেনশন করার দায়িত্ব জিদান নিবে।
এবারা আশা যাক, এই সিজনে তার স্কোয়াড রোটেশনের ব্যাপারে। গত সিজনে আমরা দেখেছি সে স্কোয়াড রোটেড তখনি শুরু করেছে যখন মোটামুটি রিয়াল ভাল পজিশনে ছিল। কথা হল, রিয়াল কি এই সিজনে শুরুতে এমন পজিশনে ছিল? উত্তর হল, না। এখন যে সিচুয়েশনে ছিল সে সিচুয়েশনে যদি নতুনদের খেলিয়ে আরো হারা লাগত তবে সেইতা সিনিয়র জুনিয়র সবার উপর প্রেশার করত। এমন না যে তাদের নিয়ে জিদানের প্ল্যান নেই। জিদানের প্ল্যান আছে। বাট জিদান চাই একজন একজন করে ডেভেলাপ হোক। কোভাচিচের সাথে ক্যাসেকে মাঠে নামিয়ে তাদের কম্বিনেশন সে ফিক্স করেছে। এর পর আস্তে আস্তে তাকে সামনে রেডি করা হচ্ছে মদ্রিচের জন্য। এইটা অনেক স্লো প্রসেস। আপনি রাতারাতি চাইলে হবে না সব। উইনিং মেন্টালিটি ক্রিয়েট করা হচ্ছে তাদের আগে কারণ ভার্সিটিতে উঠে প্রথম বছর আমাদের চলে যায় ভার্সিটির পড়াশুনা আর কালচার বুঝতেই। পড়াশুনা শুরু হয় সেকেণ্ড ইয়ারে। তাদের ক্ষেত্রেও সেইম। তারা সিনিয়র টিমকে দেখছে শিখছে। তারা দেখছে কিভাবে তারা ফাইট করে। যুদ্ধের ময়দানে পরীক্ষিত যোদ্ধা ছাড়া কাউকে নামানো হয় না। তাকে শিখানো হয় ট্রেইনিং গ্রাউন্ডে। জিদানও সেইটাই করছে এখন।
ফর্মেশন গেল। দর্শন গেল। সাম্রাজ্য গড়তে হলে দরকার রাজ্য বিস্তার। জানা দরকার প্রতিপক্ষের দূর্বলতা আর প্রপার প্ল্যানিং। আর এইটা নিয়ে থাকবে পরবর্তী আর শেষ পর্ব।