জিদান ও তার ভবিষ্যৎ

জিদান ও তার ভবিষ্যৎ

2017, Oct 10    

জিদান মাদ্রিদাস্তাদের জন্য একটি আবেগের নাম। অনেকে বিভিন্ন সময়ে জিদানের তার অতীত খেলোয়াড়ি জীবন নিয়ে অনেক পোস্ট করেছে। আমার মনে হয় না খেলোয়াড় জিদান নিয়ে আর কিছু বলার নাই । লিখতে গেলে শেষ হবে না। বরং আমার কাছে মনে হয়, তার নেক্সট টার্গেট কি হতে পারে , কি করতে পারে সে তা নিয়ে আমার এই ব্যক্তিগত মতামত। জিদান সেরা কোচ হবে কি হবে না সেইটা সময় বলে দিবে তবে সে যে ওই পথে হাটছে এইটা নিয়ে আমার মনে হয় না কোন ফুটবল বোদ্ধার মনে প্রশ্ন আসবে। জিদানের ভবিষ্যত নিয়ে পর্যালোচনা করার আগে চলুন আমরা আগে তার বর্তমান নিয়ে একটু কথা বলি । মাত্র দুই বছরের মাদ্রিদ ক্যারিয়ারে সে বর্তমানে মাদ্রিদের ইতিহাসে চতুর্থ সেরা কোচ। এইতা থেকেই আমরা বলতে পারি মাদ্রিদের ইতিহাসের সেরা কোচ হবার পথে সে ভাল ভাবেই এগিয়ে আছে। এই দুই বছরে ক্যারিয়ারে তার অধীনেই প্রথম কোন দল ব্যাক টু ব্যাক ইউচিএল জিতে(সাচ্চির সময় ইউসিএল নামকরণ ছিল না)। যা একটি অবিস্মরণীয় রেকর্ড। নিকট ভবিষ্যতে অন্য কেউ সেইটা আদোই ভাঙ্গতে পারবে কিনা সেইটা ভবিষ্যতের কাছে প্রশ্ন। তবে এইটা সত্য কথা যে ফুটবলে যে পরিমাণ এখন টাকার ঝকঝকানি, আর সব দলের মধ্যে যে পরিমাণ জিতার স্পৃহা তাতে এইটা যে খুব একটা মসৃণ পথ না সেইতা বলে দেওয়া যায়। সে হিসেবে বলা যায় জিদান যে কাজটা করে দেখিয়েছে সেইটা সবাই যে করতে পারবে তা বলা যায় না। কারণ পর পর দুই বছর রাজত্ব করতে আপনাকে শুধু আপনার মেইন একাদশ না পুরো স্কোয়াডের উপর ভরসা রাখতে হবে। কারণ আজকালকার ফুটবলটা অনেক শারীরিক। আপনি যে আপনার মেইন একাদশের সব প্লেয়ারকে সম্পূণ ফিট পাবেন তার কোন গ্যারান্টি নাই । তাই আপনার স্কোয়াডের সব প্লেয়ারকে সব সময় রেডি রাখতে হবে এই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য। আবার ইনজুরি থেকে ব্যাক করার পর ওই প্লেয়ার যখন আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগে আপনারই উচিত তার উপর ভরসা করা। কারণ সবাই মেসি রোনালদো না যে ইনজুরি থেকে এসেই আপনাকে গোলের গোল এসিস্ট উপহার দিবে। এই এইখানে জিদান অনন্য। জিদানের যে জিনিসটা সব থেকে আমাকে বেশি আকৃষ্ট করে সেইটা হল দলের প্লেয়ারদের পাশে থাকা। নিজেকে তাঁদের বিপরিটে শিল্ড হিসেবে ব্যবহার করা। যারা রিয়ালের খেলা দেখেছেন গত দুই সিজনে কেউ বলতে পারবে না কোন প্লেয়ার আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগছে। ইভেন হামেস, মোরাটা জানত তাদের ক্লাব ছাড়তে হবে তারপরেও তারা প্রতি ম্যাচে সেইম ইনটেন্স নিয়ে খেলেছে কারণ ওই যে জিদান চাই না কোন প্লেয়ার নষ্ট হোক। প্লেয়িং টাইম না পেলেই একমাত্র খেলা নষ্ট হয় প্লেয়ারদের। বাট সব সময় হয়ত সব প্লেয়ারদের প্লেয়িং টাইম দেওয়া যায় না কারণ ম্যাচ উইন রিস্ক টেকিং এর ব্যাপার গুলো এইতার সাথে জড়িত। জিদান এই সব ভ্যারিয়েবল গুলো অলওয়েজ কনসিডার করে।

এখন হয়ত অনেকে প্রশ্ন করতে পারে, “ভাই সেরা কোচ সে যে দুর্বল টিম নিয়ে ও জিতে দেখাতে পারে।উদাহরণঃ সিমিওনে, মরিনহো। তা না হলে আপনাকে পেপে কন্তের মত ট্যাকটিক্যাল রিভুলেশন আনতে হবে।“ হ্যা ভাই, আমি আপনার কথার সাথে একমত পোষণ করি। কিন্তু আপনি একটা জিনিস ভাবুন, আপনি যে ট্যাকটিক্যাল রিভুলেশন আনেন অথবা দূর্বল টিম নিয়ে কাপ জিতেন সব কিছুর মূলে কিন্তু জিতার তাগিদা থাকতে হবে। আপনার মধ্যে মোটিভেশন থাকতে হবে। আপনার মধ্যে প্রতিজ্ঞা থাকা লাগবে যে আপনি পারবেন। আপনি যতই ট্যাকট্যাকেলি ভাল হোন না কেন , আপনি যদি নিজের টিমের মধ্যে এই জিনিসগুলো গড়ে তুলতে না পারেন তাহলে ওই ট্যাকটিস জীবনেও কাজ করবে না । টিতে করন্থিয়াস কে নিয়ে যখন চেলসির সাথে মুখোমুখি হয় ক্লাব বিশ্বকাপে তখন সবাই বলছিল চেলসি ইজিলি জিতবে বাট তিতে ৪-৬-০ ফরমেশনে খেলে চেলসিকে পুরো অবাক করে দে। অথচ আমি ভুল না করলে ওই সিজনে করন্থিয়াস ওই সিজনে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতে অভ্যস্ত ছিল। তিতের এই ম্যাচে সাফল্য হল তার ট্যাকটিক্যাল ইভুলেশন না বরং আমি বলব প্লেয়ারদের কনভিন্স করা যে তার ফিলোসফিটা বুঝানো। Image

সো জিদানের কোচিং স্টাইল দেখলে বুঝা যায় তার কোচিং ফিলোসফিটা আসলে ক্লাব ফুটবলের থেকে বেশি ফিট করে ন্যাশানাল টিমের কোচের সাথে। হালের তিতে, জোরাকিম লো দের দেখুন । তিতের প্রিয় প্লেয়ার হল পৌলিনহো আগুস্তোর মত অনেক চাইনিজ প্লেয়াররা কিন্তু এরাই তিতের অধীনে খেললে অধম্য হয়ে যায় । আবার লো’রটা একটু অন্য রকম । সে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কনফেডারেশন কাপে ইয়ং টিম নামাই দিতেও ভীত হয় না। আর এদের দুইজনের একটা জোস কম্বিনেশন হল জিদান। সিজনের শুরু থেকে বেল বেনজেমাকে নিয়ে কত কিছু হল তারপরেও সে কিন্তু তাঁদের খেলিয়ে যাচ্ছে। এখন তাও বেল ফর্মে ফিরতে শুরু করেছে যদি ফিরতে পারে তাহলে বলতে হবে এইখানে ও জিদানের উইন। আবার দেখুন এই টিমই ১০ জন নিয়ে বার্সার মাঠে বার্সাকে দুইবার হারাল।এইসব জায়গা জিদানকে অন্যদের থেকে আলাদা করে রাখে। এই যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সাফল্যের ক্ষুধা। জিদান অলরেডি দুই বছরে মাদ্রিদকে যা দিয়েছে তা একজন মাদ্রিদস্তা হিসেবে আমার মনে সারাজীবন মনে থাকবে। বায়ানলেভরেকুশনের সাথে জিতার পর সে বলেছিল,”আমি মাদ্রিদের হয়ে ১০,১১,১২ তম চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ও জিততে চায়।“ এবং সে এইটা করে দেখিয়েছে একবার এসিটেন্ট কোচ আর দুইবার কোচ হয়ে । হয়ত ভবিষ্যতে আরো একটা জিতবে। নাও একবার বুকে হাত দিয়ে বলুন তো একজন ক্লাব কোচ হয়ে এর থেকে বেশি কিছু কি আর কেউ আশা করতে পারে? বরঞ্চ আমি জিদানকে দেখি একজন ট্রু লীডার হিসেবে। ফ্রান্সের যে আজ ফুটবল বিপ্লব ঘটেছে এর মূল কারণ জিদান। ফ্রান্সে তাকে ঈশ্বরের সমপর্যায়ে দেখা হয়। সেইখানে জিজু মানে অন্য রকম একতা আবেগ । অন্য রকম ভালবাসা। ‘৯৮ ফ্রান্স জিতার পর নাকি যত মানুষ বের হয়ে আসছিল ঘর থেকে তা ফ্রান্সের ইতিহাসে অনন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত মানুষ নাকি কখনো বের হয়ে আসেনি। আর সবাই তখন জিজু জিজু বলে চান্ট করছিল । ফ্রান্সে তার ভালবাসাটা এই রকম। বিনিময়ে জিজু কি করেছে ? পড়ে তাঁদের ইউরো উপহার দিল ।আর তাঁদের ভালবাসার টানে সে অবসর ভেঙ্গে আবার জয়েন করল টিমে যেখানে ফ্রান্স কোয়ালিফাই করতেই কঠিন হয়ে যাচ্ছিল আর সেই টিমকে নিয়ে গেল আরেকটা বিশ্বকাপের দাড়প্রান্তে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে কাপটা আর উঠল না। আর আপনি কি বলতে চান জিদান এইতা মেনে নিবে ? জিদানের ক্যারিয়ার চিন্তা করলে কখনো দেখা গেছে সে পিছপা হয়েছে ? না । তাই আমি অনেকটা নিশ্চিন্তে বলতে পারি জিদানই হবে ফ্রান্সের নেক্সট কোচ এবং সেইতা হবে ২০২০ সালে। এখন দেখা যাক, ফ্রান্স ফেডারেশন তাকে নিবে কিনা?এই প্রশ্নের বিপরীতে আমি পাঠকদের একটা প্রশ্ন করতে চাই ,”রিয়ালের মত বিগ টিমে এই রকম একজন অনভিজ্ঞ কোচ নিয়োগ দেওয়ার কারণ কি? সেইটা কি শুধু গা বাঁচানো?” আমার মতে তা না। পেরেজ খুব ভাল করেই জানত জিদানের ডেডিকেশন লেভেলতা কোন পর্যায়ে মাদ্রিদের প্রতি আর মাদ্রিদের প্লেয়াররা তাকে কিভাবে দেখে । ইভেন মাদ্রিদ টিমের অনেকজনের আইকনই হল জিজু। আর জিজু এসেই প্রথমেই সেই কাজটা করল সে তার লীডারশিপটা ইউস করে একটা ফ্রেন্ডলী পরিবেশ ক্রিয়েট করল সবার জন্য। ইগো ইস্যুকে দমন করল । নাও আপনারাই বলুন, ন্যাশানাল টিমে সব থেকে বড় ইস্যু কি ?? হ্যা ইগো ইস্যু। আর এই ইগো ইস্যুর জন্য ইংল্যান্ড ভাল টিম নিয়েও বিশ্বকাপে ভাল করতে পারে না । ২০১৪ সালে স্পেনের ভরাডুবিরও অন্যতম কারণ এই ইগো সমস্যা। ফ্রান্স টিম বর্তমানকালে আমার মতে সেরা একটা টিম। কোচ যদি এই টিমটাকে একটু মোটিভেট করতে পারে তাহলেই কিন্তু তারা বিশ্বকাপ জিতবে। আর এই টিমটা এখনো তরুণ বাট কয়েক বছর পরেই সব গুলো স্টার প্লেয়ার হয়ে যাবে তখন এত প্লেয়ার থাকবে টিমে যে কোন কোচের জন্য কনভিন্স করাটা অনেক টাফ হয়ে যাবে প্লেয়ারদের। আর আমার মনে হয় না পারসোনালি আগামী বিশ্বকাপে ফ্রান্স কোয়ার্টারের বেশি যেতে পারবে। এর পর থাকবে ইউরো এর সময়টায় ও জিদান হাল ধরবে না। কারণ তার কন্টাক্ট শেষ হবে ২০২০ সালে। তারমানে হল ইউরো কয়েক মাস আগে তার কন্টাক্ট শেষ হবে এন্ড আমি যদি ভুল না করি সে কন্টাক্ট রিনিউ করবে না আর মাদ্রিদের সাথে।

জিদানের মাদ্রিদের প্রতি যে ভালবাসা তাতে সে মাদ্রিদের বিপরীতে কোন টিমকে লিড দিবে এইতা সে ভাবতেই পারে না। আর এই সব কারনেই হয়ত সে ফ্রান্স টিমেই জয়েন করবে । আর ফ্রান্সে সে সাফল্য পাবে এইটা আমার মনে হচ্ছে কারণ তার অভিজ্ঞতা। সে মাদ্রিদে জয়েন করার কারণ হল সে জাস্ট নিজেকে প্রস্তুত করছে বড় স্টেজের জন্য যেমনটা তার গুরু লিপ্পি, দে বক্স রা করেছিল। আর এই দুইজনই বিশ্বকাপজয়ী। তাঁদের অধীনে খেলা জিদান অবশ্যি এই সব জিনিস লক্ষ্য করেছে। সে সাকসেস হবে এইতা মনে হবার আমার আরেকতা কারন হল তার সারভিবাল ইন্সটিক্ট। যেইতাকে আমরা আমজনতারা বলি লাক। জিদান লাকি সে খেলোয়াড় হিসেবে লাকি ছিল দুইটা গ্রেট ক্লাবে খেলে যাদের আলাদা ফুটবল দর্শন ছিল । একজনের ডিফেন্স , একজনের এটাক। সে লাকি কারণ সে দুইক্লাবেই দুই গ্রেট ম্যানেজারের অধীনে খেলেছে। নাভাই এইটা লাক না। এইটা হল পাওলো কোয়েলহোর সেই গুপ্তধন। “তুমি যদি খুব করে কিছু চাও সেইটা প্রকৃতির মধ্যে জানাজানি হয়ে যায়। আর প্রকৃতি তখন নিজ থেকে সহায় হয়।“ এইটাই আমাদের আমজনতার কাছে ভাগ্য আর সায়েন্সের ভাষায় “সারভাইবেল ইনিস্টিক্ট”। জিদান হয়ত চাইছিল আসলেই সে ফুটবলকে কিছু দিতে চায়। ফুটবলই হয়ত এই জন্য তাকে দিয়ে যাচ্ছে। সবশেষে বলি, হয়ত ২০২২ কিংবা ২৬ আমরা জিদানের হাতে সেই আরাধ্য বিশ্বকাপটা দেখব যেইটা সে ‘০৬ এ ফেলে এসেছিল। হয়ত সেদিনই প্রথম আমরা অন্য জিদান দেখব। যে শুধু কিলারই না আবেগহীন কোন যন্ত্র না বরং রক্তমাংসের সাধারণ মানুষ।

Image