রোনালদোর একক নৈপুণ্যি কি স্পেনকে রুখে দিল পর্তুগাল?
প্রশ্নটা উঠাই স্বাভাবিক। সে কিভাবে একক নৈপুণ্যে ম্যাচটি বের করে এনছে তার আগে দেখে আসি তার দল তাকে কিভাবে সার্পোট দিয়ে গেছে।
স্পেন তাদের ফরমেশন সাজিয়েছিল ৪-২-৩-১ এ রেখে ডিফেন্স করার সময় তার ৪-৫-১ এ শিফট হয়ে যায়। আমার ব্যক্তিগত মতামত এইখানে , স্পেন এতটা ডিফেন্সিভ না হলেও পারত কিন্তু প্রথম গোলটি আসলে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পর্তুগাল ও শুরু করে ৪-২-৩-১ ফরমেশনে। আর ডিফেন্সের সময় হয়ে যায় ৪-৪-২। পর্তুগাল ম্যাচ শুরুর সাথে সাথে আক্রমণাত্মক খেলা শুরু করে । এর একটা প্রধান কারণ, স্পেন কিছুটা সময় নে খেলা বিল্ড করতে আর তাই সান্তোসের মাথায় ছিল যেভাবেই হোক প্রথম ১০ মিনিটের মধ্যে একটা গোল পাওয়া। এই উদ্দেশ্যে তারা প্রথম মিনিট থেকে ম্যান ফরওয়ার্ড করতে থাকে।
স্পেনের শক্তিশালী মিডকে স্পেস ছেড়ে দিতেও তারা কার্পণ্য করেনি। আক্রমণের প্রতিটি প্লেয়ার নিজেদেরকে স্পেনের ডিফেন্স আর মিডের মধ্যে রাখতে সক্ষম হয়। স্পেনের উইক লিংক ছিল রাইটব্যাক নাচো। সান্তোস মুলত এই জায়গাটি টার্গেট করে। রন স্টাইকার হিসেবে খেললেও সে জানত রামোস, পিকের বিপরীতে তার যতটা না এরিয়াল জয়ের সম্ভবাল আছে তার থেকে বেশি সম্ভবনা আছে নাচোর বিপরীতে। সময়ের সাথে সাথে তারা নাচোকেই টার্গেট করতে থাকে । নাচোকে স্টেস করলে সেন্টার ব্যাক পিকে কেউ ও সাহায্যের জন্য আসতে হচ্ছিল আর এতে দুই সেন্টার ব্যাকের মাঝে বারবার স্পেস ক্রিয়েট হতে থাকে। আর এই ভাবেই আসে ম্যাচের প্রথম গোল। খুব একটা হার্ড ট্যাকল ছিল না নাচোর সাইড থেকে তবে পেনাল্টি পাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল রনের। এইখানে মনে রাখা দরকার, আপনি যদি ফুলব্যাকদের কোন ভাবে আউটনাম্বার করতে পারেন তাহলে আপনার মিডকে তখন ডিফেন্সিভ ডিউটি পালন করতে হবে। আর এইখানেই মূলত স্পেন মারাটা খেয়েছে। বুসকেসটস তার ডিফেন্সিভ লাইনকে কোন ভাবে সাহায্য করতে পারেনি। ম্যাচে বারবার পর্তুগাল নাচোর উপর ১ বনাম ৩, ১ বনাম ২ সিচুয়েশন ক্রিয়েট করতে সমর্থ হচ্ছিল।
গোল দিয়েই পর্তুগাল ৪-৪-২ তে শিফট করে ডিফেন্স করতে থাকে আর সুযোগ খুজতে থাকে কাউন্টারে। কথা হল, পর্তগাল ৪-৪-২ চুস করার কারণ কি।একমাত্র কারণ হল, সান্তোস চায় না স্পেনকে সেন্টার এরিয়া ছেড়ে দিতে। কোন ভাবেই যাতে সেন্টার এরিয়া এক্সপ্লয়েট করতে না পারে এইজন্য মুলত ৪-৪-২ করা। এখন দেখে আসি স্পেন কিভাবে সেইটা এনকাউন্টার করে?
স্পেনে দুইটা সেরা প্লেয়ার আছে বিটুইন দ্যা লাইনের ইস্কো এবং সিলভা। এরা মুলত যে কাজ করে বারবার নিজেদের বিটুইন দ্যা লাইনে নিয়ে যায় আর বাম প্রান্তে ওভারলোড করতে থাকে। বাম প্রান্ত করার কারণ হল, নাচো আলবার মত এটাকিং না। কার্ভা থাকলে হয়ত তারা দুই প্রান্তেই সমভাবে আক্রমণ চালাত।
মূলত এই ছোট ট্রায়াঙ্গলেই সমস্যা করতে থাকে পর্তুগালের ডিফেন্সিভ শেইপে। সো এইটার নিয়ম কি, ইনিয়েস্তা যদি ডিপে থাকে তাহলে ইস্কো নিচে নেমে আসবে আর তখন ডিফেন্স থাকা প্লেয়ার কনফিউশনে সে কি ইস্কোকে ফলো করবে নাকি শেইপ মেইনটেইন করবে। এখন শেইপ মেইনটেইন করতে গেলে এই ফ্লোটিং ট্রায়াঙ্গল প্রেস করতে করতে উপরে উঠছিল শুধুমাত্র একটা প্লেয়ারকে টার্গেট করে আর প্লেয়ারটির ও এই অবস্থায় কিছু করার নেই। আর যদি না প্রেস করে তাহলে কেমন হচ্ছে,
ছবিতে দেখুন, তখন ৫ নাম্বার বুসকেটস মিডের কন্ট্রোল নিচ্ছে। এর ফলে ৬ নাম্বার কোকে ইনসাইড রনকে মার্ক করছে । দুই সিবি দুইটা ওয়াইড এরিয়া কভার দিচ্ছে তার মানে দাঁড়াল ফুলব্যাকরা এখন পিচ হাই আপ করতে পারবে।কাউন্টারের ও ভয় নেই। ম্যাচে খেয়াল করলে দেখা যাবে, কস্তা(নাম্বার ৯) স্ট্যাটিক স্টাইকার থেকে এইখানে ফলস ৯ এ নিজেকে শিফট করে। যেহেতু সে ড্রপ হচ্ছিল বারবার দেখুন কিভাবে সে একা ৪ জন ডিফেন্ডারকে এট্রাক্ট করছে। বার্সা তে গার্দিওলা এই সিস্টেমই ডিপ্লয় করে গিয়েছিল। আর স্পেন দলে এসে কস্তা ও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে এই সিস্টেমের সাথে।কস্তার ইনসাইড এ আসা অনেকগুলো সমস্যা সৃষ্টি করছিল পর্তুগালের ডিফেন্সে। প্রথম, সে নিজে একটা পাসিং অপশন হচ্ছিল, দ্বিতীয়ত, সে আলবাকে বারবার উইং এ ফ্রী করে দিচ্ছিল। এবং শেষমেশ, সিলভাও স্টাইকার পজিশনে চলে আসতে পারছিল সহজে। পুরো ম্যাচ জুড়েই স্পেন এই ট্যাকটিস ফলো করে আর এইটার জবাব দেওয়ার মত কোন কিছু পর্তুগালের ছিল না। বরং তারা ফোকাস করে কাউন্টারের দিকে। ডিরেক্ট এপ্রোচ। পজেশনাল ফুটবলের কারণে বারবার রামোস, পিকে দুইজনকেই হাফলাইন ক্রস করে উপরে উঠে আসতে হচ্ছিল পজেশন ধরে রাখার জন্য। আর এই সুযোগটাই নিচ্ছিল বারবার পর্তুগাল। একটা ভুলেই দ্রুত কাউন্টার।
ম্যাচে আরেকটি ব্যাপার লক্ষণীয় ছিল স্পেনের সাইড প্রেস। পর্তুগালের বিল্ড আপের সময় তারা বারবার ৪-৫-১ করে ফেলে নিজেদের হাফে প্রথমে তারপর শুরু করে সাইড প্রেসিং। সাইড প্রেস করতে থাকে যাতে তারা পিছনে ছাড়া কোন ভাবে সামনে পাস করতে না পারে।আর এইটার জন্য মুলত রনের মাঝে মাঝে নিচে নেমে আসা। রন বারবার চেষ্টা করছিল নিচে নেমে এসে খেলাটা বিল্ড করার কিংবা বলা যায়, স্পেনের মিডফিল্ডকে বাইপাস করার। কিন্তু স্পেনের হাই প্রেসে ব্যাপারটা অসম্ভব ছিল একদমই।
স্পেন মূলত প্রথম গোলটা পায় বুসকেটস আর কস্তার ব্রিলিয়ান্সের কারনের। দ্রুত ট্রাঞ্জিশন আর অসাধারণ পাস পাশাপাশি কস্তার বল কন্ট্রোল, গোল সবই ছিল অসাধারন। অন্যদিকে, পর্তুগাল দ্বিতীয় গোলটি পাই মুলত ডি গেয়ার ভুলে। এইটা ট্যাক্টিক্যালি না কোনভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না।
তবে স্পেনের দ্বিতীয় গোলটা ছিল আরেকটি ব্রিলিয়ান্ট ট্যাকটিসের ফসল। স্পেন দলটি যে এইবার খুব ভালভাবে অনুশীলন করে এসেছে বিশ্বকাপে সেইটা বুঝা যায় এই গোলের মাধ্যমেই। সিলভার ফ্রিকিক নেয় নাচোকে লক্ষ্য করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, কস্তা সেটপিস নেওয়ার সময় বারবার নাচোর পজিশন লক্ষ্য করছিল। সে সব থেকে লেইট রান দেয়। কারণ পর্তুগালের সবাই ভাবে নাচোই হেড করবে। বাট বাস্তবতা হল নাচো ছিল এইখানে স্টেশন। সে বলটা প্লে করে ইনসাইডে। এবং কস্তার ফ্রী মার্কিং গোল।
থার্ড গোলটাও স্পেনের আসে নাচোর আরেক বিলিয়ান্সের মাধ্যমে। পুরো ম্যাচে সাফার করা নাচো এই দুইটা কন্ট্রিবিউশন অবশ্যি প্রশংসাযোগ্য। এইদিকে পিছিয়ে পড়ে পর্তুগাল বারবার ম্যান ফরওয়ার্ড করতে থাকে। আর এইখানে আমার মনে হয় স্পেন একটি ভুল করে। পর্তুগাল তখন বারবার স্পেস ছেড়ে দিচ্ছিল দুই উইং এ। এই সময় এসেন্সিও সাবস্টিউটটা খুবই জরুরী ছিল বলে আমি মনে করি। প্রথমত সে ডিফেন্সভলি সাহায্য করতে পারত আবার ডিরেক্ট কাউন্টার এপ্রোচ ও করা যেত তাকে দিয়ে।
ম্যাচ গড়াতে থাকে এইভাবে আর শেষ মুহুর্তে দেখা যায় ক্রিশ্চিয়ানোর ব্রিলিয়ান্স। প্রথমত পিকে কেন ওই জায়গায় তাকে ফাউল করতে গেল সেইটা আমার বোধগম্য না।ম্যাচের এমন সিচুয়েশনে ওই জায়গায় ফাউল খুবই কষ্টকর ব্যাপারটা ধরা। খেয়াল করলে দেখা যাবে, পুরো ম্যাচে ১ বনাম ১ সিচুয়েশনে রন বারবার পিকে কে চাচ্ছিল এবং রামোসকে এডিয়েই চলছিল । এর মূল কারন হয়ত পিকের উপর চাপ সৃষ্টি করা। যে কারণেই হোক রোনালদো তার পরিকল্পনায় সফল। আমরা সবাই দেখলাম একটা অসাধারণ ফ্রিকিকের।
এইবার আসি রোনালদোর কিছু বিলিয়ান্ট মোমেন্টের এই ম্যাচের।
১. লীডারশিপঃ ম্যাচে ঘুরে ফিরে দেখলে দেখা যাবে সে বারবার টিমমেইটদের হাত দিয়ে বলে দিচ্ছিল কাকে পাস দিতে হবে। কোথায় বল দিতে হবে। কোন পজিশনে দাঁড়াতে হবে।
২. বিল্ড আপঃ বারবার যখন দল স্পেনের হাই প্রেসে খেলতে পারছিল না নিচে নেমে এসে সে চেষ্টা করে গেছে খেলা বিল্ড করতে যদিও খুব কম। কিন্তু যতবারই এসেছে বল ফরওয়ার্ড হয়েছে কিংবা এটাক হয়েছে।
২. ফ্রিকিকঃ এইটা নিয়ে বলার কিছু নেই।
৪. পেনাল্টিঃ হা দেখতে খুবই সাধারণ মনে হলেও এইটাই কিন্তু ম্যাচ ঘুরিয়েছে । পেনাল্টির সময় ডি গেয়া চেষ্টা করে রনের সাথে আই কন্টাক্ট করতে তাকে ইনটিমেট করতে। রামোস ডি গেয়াকে বলে রন পেনাল্টি নিবে ডি গেয়ার ডানে।সম্ভবত ট্রেনিং গ্রাউন্ডে রন হয়ত বেশি এই সাইডেই মারে। রনের চোখের পজিশন ও বারবার বলছিল সে ওইদিকেই শট নিবে। কিন্তু না সবাইকে বোকা বানিয়ে রন শটটা নে ডি গেয়ার বামে। আর এইটার পর রামোসের রিএকশন ছিল, “F**k”