কতটুকু প্রস্তুত সারির চেলসি লীগ জিততে? (সারিজম)

কতটুকু প্রস্তুত সারির চেলসি লীগ জিততে? (সারিজম)

2018, Aug 19    

বর্তমান সময়ের আক্রমণাত্মক ফুটবল মানেই পজেশনাল ফুটবল।এইবারের বিশ্বকাপে পজেশনাল ফুটবলের ভরাডুবি হলেও আগাম ভবিষ্যতে এর ভবিষ্যত উজ্জ্বল।কারণ, বর্তমান সময়ের সেরা সব কোচই কম বেশি কাজ করছে এই নিয়ে। কিংবা পজেশনাল সিস্টেমকে আরো উন্নত করা যায় কিভাবে পজেশন ধরে রেখে কাউন্টার সিস্টেম ব্লক করা যায়। আর এই পজেশনাল ফুটবলের নতুন ধারনা নিয়ে চেলসিতে কন্তের স্থলাভিষ্কিত হয়েছেন নাপোলির সারি।

সারি আমার পছন্দের একজন কোচ।প্রচন্ড রকম একগুয়ে স্বভাবের কিন্তু কম ডিমান্ডেবল। আর এই জন্য নাপোলিতে থাকতে বোর্ড কিংবা কোন খেলোয়াড়ের সাথে তার কোন সমস্যার কথা আমাদের জানা নেই। তার খেলার ধরণেও এর প্রমান পাওয়া যায়।যারা ফুটবলে গোলের খেলা দেখতে ভালবাসেন। যারা মনে করেন ফুটবল মানেই গোল উৎসব। তাদের জন্য মুলত সারি। গত সিজনে ম্যাচপ্রতি সিরি আতে নাপোলির গড়ে দুই গোল প্রমান করে চেলসি এই সিজনে কতটা আক্রমনাত্মক খেলবে। আর এই গোল গুলো করার জন্য নাপোলির বড় কোন স্টার প্লেয়ারের দরকার ছিল না। দরকার ছিল শুধু নিজেদের মধ্যে বিশ্বাস রাখা আর সিস্টেমটাকে আয়ত্ত্ব করা।

ডিফেন্স কি জিনিস সারি তা জানে না। সারি জানে শুধু আক্রমণ করতে।অন্যদিকে, চেলসি সুপরিচিত তাদের বাস ট্যাকটিসের জন্য যার জন্য বল পজেশনটা গুরুত্বপূর্ন ছিল না এতদিন। তাই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে এত অল্প সময়ে কি সম্ভব সারি সিস্টেম রপ্ত করা চেলসির পক্ষে?

সারি সিস্টেম অনেক কমপ্লিকেট একটা সিস্টেম। পজেশন বেসড সিস্টেম হলেও এইটা শুধু বল দখলে রাখা কিংবা স্পেস দখলে রাখা না। সারির সাকসেস মুলত দ্রুত ফরমেশন পরিবর্তনের মাধ্যমে গেইম কন্ট্রোল করা। সারির সিস্টেম বুঝতে গেলে আপনার ধারণা থাকা লাগবে হাফস্পেস নিয়ে। অন্য কোন সিস্টেমে হাফস্পেস এতটা গুরুত্বপূর্ন কিনা আমার জানা নেই। তবে সারির সিস্টেমে হাফস্পেস অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ন। কারণ তার পুরো খেলাটাই হয় হাফস্পেসে।

sa1

সারি আক্রমণের জন্য ব্যবহার করে ৪-৩-৩ পজেশন বেসড সিস্টেম। তবে অন্যান্য পজেশন বেসড সিস্টেমে যেখানে বাকিরা উইংগারদের ওয়াইড প্লেয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সারি সিস্টেমে সেইখানে ফ্রন্ট ৩ কে ন্যারো হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অর্থ হল, নাম্বার ৯ সেন্টার এরিয়া দখল করবে আর বাকি দুই উইংগার হাফস্পেস কভার দিবে। এর ফলে দুই ওয়াইড এরিয়াতে দুইটা ফুলব্যাক পুশ করানোর সুযোগ থাকে। কিন্তু এইখানেও আছে সারি ম্যাজিক। অন্যান্য কোচরা যেখানে দুই ফুলব্যাককে উপরে পুশ করতে চায়। সারি সেইখানে শুধু একটা ফুলব্যাক দিয়ে আক্রমণ চালায়। অন্য ফুলব্যাকের দায়িত্ব থাকে মুলত ডিফেন্স লাইন কভার দেওয়া । তৃতীয় সিবি হিসবে ব্যবহৃত হয় ফুলব্যাক। ফলে পজেশনাল সিস্টেমের বিপরীতে আপনার যদি কাউন্টার বেসড সিস্টেম থাকে সেইটা এইখানে কার্যকর হবে না।

sa2

অন্যান্য পজেশন বেসড কোচদের মত সারিও ব্যাক থেকে বিল্ড করতে পছন্দ করে আর এই জন্য গোলকিপারের পায়ে দক্ষ হওয়াটা জরুরী। কেপাও বল পায়ে মোটামুটি ভাল যদিও অনভিজ্ঞ। দুই সিবি ডিফেন্সের দুই হাফ স্পেস কভার করে আর এর মাঝে এসে গেইম কন্ট্রোল করে একজন সিডিএম। আর সে হল জজিনহো। জজিনহো পজিশনটা সারির সিস্টেমে সব থেকে গুরুত্বপূর্ন অংশ। জজিনহোর রোলটা অনেকটা পেপের বুসকেটসের মত এইখানে। জজিনহো প্রেশার অবজর্ব করে সঠিক পাস দিতে পারে। তবে বুসকেটসের মত এতটা ক্রিয়েটিভ সে না। কিন্তু তারপরেও সেই হল কী প্লেয়ার।

সারির দল ভার্টিকাল কিংবা হরিজন্টাল দুই রকম পাসেই খেলতে পারে। জজিনহোই সিদ্ধান্ত নেয় পাস কি ভার্টিকাল হবে নাকি হরিজন্টাল। আক্রমণের উদ্দেশ্য থাকলে ভার্টিকাল আর লীডে এগিয়ে থাকলে হরিজন্টাল । তবে সারি ভার্টিকেলই বেশি পছন্দ করে। কারণ ওই যে বললাম সারি ফুটবল মানেই বুঝে আক্রমণ। তবে সারি এইটার জন্য জজিনহোর বুদ্ধিমত্তাকে বিশ্বাস করে। খেলা বিল্ড আপ করা ছাড়াও জজিনহোর আরো কাজ আছে সারির সিস্টেমে। সেইটা আমরা ক্রমান্বয়ে জানব।

সারি সিস্টেমে ডিফেন্সে দুই সিবিকেই বল প্লেয়িং হতে হবে । সে জন্য বলা যায় লুইজ এবং রুডিগার এক রকম ফিক্সড। দুইজনেই বল প্লেয়িং সিবি কিন্তু ডিফেন্সিভলি দূর্বল। নাপোলি থাকাকালীন তাদের ডিফেন্ডার কোলেবালি ছিল তাদের মিসিং লিংক। বল পায়ে কিংবা সারির হাই ডিফেন্স লাইনে সে এতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত না। কথা উঠেছিল তাকে বেচে দেওয়ারও। কিন্তু সারি ট্রান্সফার মার্কেটে ততটা আগ্রহী নয়। তাই বোর্ডকে অনুরোধ করে কোলেবালির জন্য আলাদা ট্রেইনিং সেশনের ব্যবস্থা করেছিল সারি। ফলাফল, গত সিজনে তার পারফরম্যান্স দেখলেই বোঝা যায়। আর এই বল প্লেয়িং এবিলিটির জন্য ইউরোপের অনেক নামী দামী ক্লাবই তার পিছনে ধরনা দিয়েছে এমনকি চেলসিও। তবে আপনার হাতে যদি পন্যের উদ্ভাবক থাকে আপনি পণ্য দিয়ে কি করবেন?

মিডে সারি একজন ক্রিয়েটিভ মিড আর একজন বক্স টু বক্স মিড ব্যবহার করে। কান্তেকে এখন আগের থেকে আরো এডভান্স পজিশনে দেখা যাবে। এই সিজনে তার থেকে তার ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ গোল আশা করা যায়। সমস্যা হল, অন্য পজিশনে। বারকেলি ক্রিয়েটিভ মিড হলেও ডিফেন্সভলি বেশি দূর্বল। আক্রমনে সঠিকভাবে কন্ট্রিবিউট করতে পারলে ও সময়মত এসে ডিফেন্স কিংবা কাউন্টার প্রেস করতে সে এতটা সক্ষম না। তবে কোভাচিচের ইঙ্কলুয়েশন চেলসি ভক্তদের দুশ্চিন্তা কমাতে পারে। গতকাল আর্সেনাল ম্যাচেই আমরা দেখেছি তার পাস সাকসেস রেইট এবং দ্রুত বল উইনিং ক্যাপাবিলিটি। সন্দেহ নেই, আর ম্যাচ দুয়েক পরেই সে রিগুলার স্টার্টার হবে দলে। পাশাপাশি হাতে আছে রুবেনের মত ট্যালেন্টেড প্লেয়ার। তাই আপাতত চেলসির মিডে তেমন বড় কোন সমস্যা নেই বললেই চলে।

এই বার আসা যাক তার প্রেসিং স্টাইল নিয়ে, যার জন্য সে বিখ্যাত। সারি ম্যান ওরিয়েন্ড সাইড প্রেস করে। বেশিরভাগ সময় সে বাম প্রান্তে প্রেস করে থাকে। কেন জানি না, সারি পুরো খেলাটা বাম প্রান্তেই খেলতে চায়। প্রতিপক্ষকে কখনো সুইচ প্লে করতে দিতে সে চায় না। মোটামুটি ৯০ মিনীটের ৬৫ মিনিটেই দেখবেন খেলা হচ্ছে বাম প্রান্তে। আর এইজন্য আলনসো খুবই গুরুত্বপূর্ন। পাশাপাশি আলনসো স্পেস কভার দেওয়ার গুরু দায়িত্ব পড়বে লুইজের উপরও।

সারি সিস্টেমের সব থেকে মজার ব্যাপার হল, সারি যদি দেখতে পায় কোনভাবেই আপনার ডিফেন্স লাইন ভাঙ্গা যাচ্ছে না তাহলে তার দল নিজ থেকে এলাও করবে আপনাকে প্রেস করার জন্য। আর আপনি প্রেস করতে গেলেই হল । এইবার দুই ফুলব্যাক মিডে এসে ৩-৪-৩ সৃষ্টি করবে । এই ৩-৪-৩ সিস্টেমে ভার্টিকাল পাসিং অপশন ও বেড়ে যায় প্লেয়ারের কাছে।

sa3

যেহেতু সারির মূল অস্ত্র দ্রুত ছোট পাস দিয়ে বল বের করে আনা। তাই ফ্রাস্ট প্রেশার ব্রেক করে ফেললে প্রতিপক্ষের জন্য খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় পজেশন রিগেইন করা। তাছাড়া সারির দল কখনো আপনাকে এক সেকেন্ডের জন্যো বল নিয়ে চিন্তা করতে দিবে না । প্রথম মিনিট থেকে শুরু করে ৯০ মিনিট পর্যন্ত সমতালে প্রেস করে যাবে। আর বল হারালে কাউন্টার প্রেস তো আছেই। যেহেতু ফ্রন্ট ৩ এর পজিশন খুব ন্যারো হয়। পাশাপাশি দুইজন মিড থাকে অতিরিক্ত তাই দেখা যায় বল হারালেও খুব দ্রুত কাউন্টার প্রেস করে বলের দখল নিতে আবার সক্ষম হয় তারা। এইখানে এইটাও মাথায় রাখতে হবে ছোট পাসের জন্য তারা ট্রায়াঙ্গল ও সৃষ্টি করে অনেক ছোট। ফলে প্রেস করলেও এইটা তারা ঠিকই বল বের করে আনতে পারে।

এইবার আসা যাক ডিফেন্স নিয়ে। সারি ডিফেন্সের জন্য দুই রকম ফরমেশন ব্যবহার করে । ৪-৫-১ এবং ৪-৪-২ । এবং দুইটা দুই কাজে ব্যবহার করা হয়। ৪-৫-১ দিয়ে সে নিজেদের অর্ধে প্রেস করতে ব্যবহার করে আর ৪-৪-২ তে প্রতিপক্ষের অর্ধে । আর এই পুরো সিস্টেমটা কন্ট্রোল করে জজিনহো। কারন অন্যান্য পজেশন বেসড সিস্টেমর মত সবারই এইখানে পজিশন ইন্টারচেঞ্জ করা লাগে না । ১ জজিনহো পজিশন পরিবর্তন করলেই ফরমেশন পরিবর্তিত হয়ে যায় । কিভাবে সেইটার জন্য নিচের ছবি দুইটো লক্ষ্য করুন।

sa4

sa5

৪-৫-১ এ জজিনহো সুইপার হিসেবে কাজ করবে। মিড এবং ডিফেন্সের মধ্যে কানেক্টর। পাশাপাশি দুই জায়গাতে সুইপার হিসেবে ব্যবহৃত হবে। আবার ৪-৪-২ তে স্টাইকারের সাথে প্রেস করতে উঠে যাবে কান্তে। তখন তার প্লেইসটা নিবে জজিনহো। চিন্তা করে দেখুন, শুধুমাত্র একটা প্লেয়ারের পজিশন চেঞ্জ করে কতভাবে ফরমেশন পরিবর্তন করা যায়। আর এই জন্য মুলত আসার সময় সাথে করে জজিনহোকে নিয়ে আসা সারির। কারণ তার সিস্টেমটা যে সব থেকে ভাল বুঝে জজিনহোই।

এখন দেখুন এই দুই সিস্টেমই বল উইন করলে শুধুমাত্র এটাকিং মিডকে ফরওয়ার্ড করলেই আবার ৪-৩-৩ হয়ে যায়। আর এইটাই হল প্রতিপক্ষের জন্য মূল সমস্যা। বল যে পজিশনে হারায় সারির দল সে পজিশন থেকেই ৪-৩-৩ সিস্টেম খেলতে পারে । ফলে ব্যাক পাস দিয়ে খেলা বিল্ড করার আর তাদের দরকার পড়ে না। আর এত দ্রুত শিফটিং কারণে প্রতিপক্ষ পুরো আউট অফ পজিশন হয়ে যায়।

নাপোলিতে সারি এই ফ্লুয়েডিটির জন্য বিখ্যাত ছিল। এত র‍্যাপিড ফরমেশন পরিবর্তন খুব কম কোচই দেখাতে পেরেছিল।

সারি প্রতিপক্ষকে উইং এরিয়া ছেড়ে দেয় । সেন্টার ফোকাসড ডিফেন্স করে একদম। মিড এবং ডিফেন্স দুইটায় একদম বক্সে ডিফেন্স করে । কিন্তু সমস্যা হল, যেহেতু তাদের সব সময় ফোকাস থাকে প্রেস করা তাই বেশিরভাগ সময়ই তারা ম্যান মার্ক করতে ভুলে যায়। জিদানের মাদ্রিদ জিতেছিল সেট পিসে গোল করে। সেই ম্যাচেও নাকানী চুবানি খেয়েছিল একপ্রকার মাদ্রিদ। আবার পেপের সিটিকে ও সেইম অবস্থা। গার্দিওলা মনে হয় তার ক্যারিয়ারে প্রথম কোন ম্যাচ কাউন্টার এটাক দিয়ে জিততে বাধ্য হয়েছিল। সারির প্রেসিং স্টাইল এতটাই ভয়াবহ রকমের ।

সব শেষে বলা যায়, প্রিমিয়ার লীগ জিতা সহজ কাজ নয়। তাছাড়া সিস্টেমের সাথে মানিয়ে নেওয়ারও ব্যাপার আছে। তবে এইটা সত্য, লীগ জিতার জন্য চেলসি ভালই ফাইট করবে। অন্যান্য দলগুলোর যখন চ্যাম্পিয়ন্স লীগ নিয়েও মাথা ঘামাতে হবে, চেলসির তখন সম্পুর্ণ ফোকাস থাকবে লীগের উপর। আর এইটাই হল অন্যদের জন্য ভাইটাল। এই সিস্টেমে আপনার প্রচুর এনার্জী নষ্ট হবে যেহেতু অতিরিক্ত খেলা লাগবে না তাই বলা যায় পুরোদমেই তারা আবার মাঠে নেমে পরবে যেইটা প্রতিপক্ষের জন্য আসলেই হুমকিস্বরূপ।