রোনালদোর বিদায়ঃ প্রফেশনলাজিম নাকি অভিমান?
একজন মাদ্রিদস্তা হিসেবে রোনালদোকে নিয়ে লিখাটা খুবই কষ্টজনক। পছন্দ করুন অথবা ঘৃণা করুন মানতেই হবে, মাদ্রিদের ইতিহাসে একটা বড় অংশ এখন রোনালদোর সাথে জড়িত। টানা ৩ বার জয়ী উচল জয়ের জন্য নয় শুধু। পুরো মাদ্রিদের ইতিহাসে এমন কোন ব্যক্তিগত রেকর্ড আছে যেইটা রোনালদো ভাঙ্গতে পারেনি?
আমার কথা গুলো হয়ত এখন স্বার্থপরের মত শুনাবে। কিন্তু তারপরে ও আশা করি আপনারা বিচার বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করার চেষ্টা করবেন। চেষ্টা করবেন বুঝতে ম্যানেজমেন্ট কি চেয়েছিল। প্রতিটা ক্লাবের জন্য প্ল্যানিংটা গুরুত্বপূর্ণ। রিয়াল মাদ্রিদের মত ক্লাবে সেইটা আরো বেশি। এরা প্রতি বছরই নিজেদেরকে টপ লেভেলে দেখতে চায়। আর এইটাই হল একটি সমস্যা। আপনি যখন নিজেকে টপ লেভেলে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইবেন আপনার মধ্যে আবেগটা কমিয়ে আনতে হবে। প্রফেশনালজিমের মধ্যে আবেগের স্থান নেই। রনের চলে যাওয়া এই প্রফেশনালিজমের মধ্যেই পড়ে।
রন প্রায় সময় একটা কথা বলত, “আমি মাদ্রিদে ৪০ বছর পর্যন্ত খেলতে চাই এবং এইখানেই অবসর নিতে চায়।” হা কথাটা শুনতে খুবই আনন্দাদায়ক হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। রনের বয়স সামনেই ৩৪ হবে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সে এখনো প্রতি সিজনে ৫০+ গোল পাচ্ছে। কিন্ত পরিসংখ্যান অনুসারে এইটাও সত্য, তার ম্যাচ খেলার পরিমান প্রতি সিজনেই কমছে। জিদান তাকে কন্ট্রোল করতে পারত। কিন্তু কথা হল, এই বয়সে, এই ফর্মে নতুন কোচ কি আদৌ তাকে রাজি করাতে পারবে? আবার প্রশ্ন হল, আপনি যখন টপ ফর্মে থাকবেন ব্যাপারগুলো তেমন একটা লক্ষ্য হয় না। হঠাৎ করে ফর্ম হারিয়ে ফেললে ভক্তরাই কি তাকে মেনে নিবে? তার অফফর্মে থাকা অবস্থায় মাদ্রিদের ব্যু গুলো কিন্তু নতুন কিছু নই । এই বয়সে এসে আপনি কি ব্যক্তিগত ভাবে চাইবেন এত প্রেশার নিয়ে খেলতে? আর এইজন্য রোনালদো তার চিঠিতে বলেছে
They (the fans) have been absolutely wonderful for nine years. These nine years have been unique. It has been an exciting time for me, full of consideration but they have also been hard because Real Madrid have very high demands
দেখুন সে কিভাবে হাই ডিমান্ড এবং ফ্যানদের উপর ফোকাস করেছে তার লেখায়। জিদানও কিছুদিন আগে প্রায় একই শব্দ ব্যবহার করেছিল, “High Demand”. হা আমরা মাদ্রিদস্তারা অনেক বেশি হাই ডিমান্ডেড। এই সিজন যদি ট্রফিলেস যাই, আমরা পেরেজকে দোষারোপ করব, ম্যানেজমেন্টকে করব। আবার যদি রন থাকার পরেও ট্রফিলেস গেলে হয়ত কোচের ট্যাক্টিস এই সেই নিয়ে প্রশ্ন তুলব। কিন্তু আপনি দেখুন, এই আর্সেন ওয়েঙ্গার, লিভারপুল এদের সমর্থকরা বছরের পর বছ কিছু না জিতে ও এক রকম বলতে গেলে তাদের খেলোয়াড় নিয়ে প্রশ্নই তুলে না। এইজন্য এই সব ক্লাব থেকে অবসর নেওয়া যতটা সহজ মাদ্রিদ থেকে ততটা না। আমরা যাকে লিজেন্ড মানি সেই স্টেফানোর স্বপ্ন ছিল মাদ্রিদের জার্সি গায়ে সে অবসর নিবে। কার জন্য হয়নি জানেন? হা আমাদের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট যাকে আমরা আদর্শ মানি সান্তিয়াগো বানাব্যু । তার শেষ দুই বছর কাটে ইস্পানিওলের হয়ে। অথচ এই দুই বছর খুব সহজে তাকে বানাব্যুতে রাখা যেত তাই নয় কি? কিন্তু এইখানে ডিমান্ড এত হাই যে আসলে একটা সময় পর খেলোয়াড়রা সেইটা নিতে চায় না। তখন তাদের হাতে অপশন থাকে দুইটি। হয় অবসর না হয় নতুন স্টার্ট।
জিদান ছিল প্রথম শ্রেনীর । মাত্র ৩৪ বছর বয়সে সে অবসর নিয়ে ফেলে।হা আর এইজন্য সে তার শেষ মায়চতি বানাব্যুতে খেলতে পারে সহজে। আরো বছর দুয়েক খেলার পরিকল্পনা করলে হয়ত পেরেজই তাকে বেচে দিত। রোনালদোর ক্ষেত্রে সত্য হল দ্বিতীয়টা। রন এখনো যে ফর্ম আর ফিটনেস আছে সে এখনোই হাল ছাড়তে প্রস্তুত নয়। আর বছর দুয়েক খুব সহজে টপ লেভেলের সাথে ফাইট দিতে সে রাজি। প্রশ্ন হল, মাদ্রিদ কি তা তাকে দিবে? মাদ্রিদের ইতিহাস বলে, “এইটা সম্ভব না”। মাদ্রিদ তাকে খেলাবে যদি সে রাজি থাকে বেঞ্চ হতে। তাহলে হয়ত মাদ্রিদ রনের অলটারনেটিভ বানাতে পারবে। কিন্তু রন কি এইটা মেনে নিবে? সে নিজে যেখানে জানে সে এখনো টপ লেভেলে খেলতে পারবে সেইখানে কি সেই বেঞ্জ হতে রাজি হবে? ঠিক একই ব্যাপারটা ঘটেছিল ইকারের সাথেও। ইকারের ফর্ম চলে গিয়েছিল। কোচ তাকে বেঞ্জ করিয়েছিল। এমনটা না যে পেরেজ তাকে ট্রান্সফার উইন্ডতে তুলেছিল। মুলত ইয়াকরি পারসোনাল রিকুয়েস্ট করেছিল তাকে সেল করে দেওয়ার জন্য পোর্তোতে। মাদ্রিদে কম বেশি যারা খেলতে আসে সবাই এই সত্যটা জেনেই আসে। আপনি পিক লেভেলে থেকে অবসর না নিলে মাদ্রিদে ফেয়ারওয়েল আশা করাটা বোকামী। এক মাত্র গিন্টোই সম্ভবত ৩৭ বছর হয়ে ও মাদ্রিদে অবসর নিতে পেরেছিল আর শেষ সিজনে কয়টা ম্যাচ খেলেছিল জানেন? মাত্র ৭টা। হা জাস্ট ইমাজিন করুন, রোনালদো পুরো সিজনে মাত্র ৭টা ম্যাচ খেলছে। এইটা কি অপমান বলবেন নাকি ট্যাক্টিক্যাল নাকি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
রনের স্যালারী যখন বাড়াচ্ছিল না পেরেজ তখনই হয়ত নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল তাদের মধ্যে সম্পর্ক শিথীল হতে চলেছে। বানাব্যুর সাথে স্টেফানোর এই রকম ইস্যু ছিল। এইটাকে বলা যায় মূলত একটা কারণ। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না, মাদ্রিদের সামর্থ্য নেই রনের স্যালারী দেওয়ার।কিন্তু সমস্যা হল, তারা রনকে আর রাজার পদে চায় না। অনেকটা এমন, তারা চায়, রাজার বয়স হয়েছে সে নিজ থেকে সরে দাঁড়াক অথবা নতুন কেউ রাজা হোক। মুল কথা হল, গদিটা ছেড়ে দিক। আর পৃথিবীতে মনে হয় না কোন রাজা যার এখনো নিজের উপর বিশ্বাস আছে সে এইভাবে সরে দাঁড়াবে কিংবা তার রাজত্বে অন্য কোন রাজাকে কুর্নিশ করবে। তাই রনের সরে দাড়ানোটা অবিশম্ভাবীই ছিল। যদিও আমরা মাদ্রিদস্তারা বিশ্বাস করে গিয়েছিলাম শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত সে থাকবে। আর এইতা হল আবেগ। ব্যবসায়িক ভ্যালুতে যার নিতান্তই কোন মূল্য নেই। এই সিদ্ধান্তটা ক্লাব প্রেসিডেন্টের একার হাতে থাকে না। ক্লাবের সাথে জড়িত শেয়ার হোল্ডার থাকে আরো অনেক কিছু থাকে যে সব ভেরিয়েবল গুলো শুধু মাত্র ওই পদে গেলেই বোঝা যায়।
এখন আসি রন কেন জুভেন্টাসকে পছন্দ করল? খুব সহজে কিছু ভেরিয়েবল মিলালেই পাওয়া যায়। রনের এখন যা বয়স তাতে সে খুব ভাল করেই জানে টপ লেভেলে সে আরো বছর চারেক সহজেই খেলতে পারবে। কিন্তু এই বয়সে এসে কেউ চায় না প্রেশার নিয়ে খেলতে বরং রিলাক্স থেকে খেলা যাওয়াটাই ক্যারিয়ারের জন্য ভাল। তার মোড় ঘুরানোর মত সিদ্ধান্ত আসে মনে হয় জুভের বিপক্ষে সেই দর্শনীয় গোলের পর। post match ইন্টারভিউতে সে বলেছিল,
That was one of the nicest moments I’ve had this evening.For people to applaud me at a stadium like that of Juventus, where they’ve had great players and where they have great players, is a top moment.I’m very happy and excited because this has always been a club that I’ve liked since I was a little boy.
আমরা মাদ্রিদ ফ্যানরা বানাব্যুতে এত বছর সুযোগ থাকার পরেও তাকে কতবার স্ট্যান্ডিং ওভিয়েশন দিয়েছি? ধারণা করা যায়, স্ট্যান্ডিং ওভিয়েশনটাই তাকে নতুন ভাবে ভাবাতে শুরু করে। সে জানত, তাকে ক্লাব ছাড়তেই হবে। হয়ত ওই স্ট্যান্ডিং ওভিয়েশন না পেলে সে এখন আবার ম্যান ইউতে খেলত অথবা রিয়ালেই থেকে যেত। কিন্তু এইটা তার চিন্তা ধারায় বড় একটা প্রভাব ফেলে বলে আমি মনে করি। সে মোটামুটি এইটা নিশ্চিত হয়, তার খারাপ সময় গেলেও এরা তার পাশে থাকবে। ইভেন সে যদি সিজনের পর সিজন গোল ও নায় তাও জুভের ফ্যানরা তাকে গালিগালাজ ব্যু দিবে না। কারণ ওই সম্মানটুকু সে আদায় করে ফেলেছে আগেই। আর তাই যতদূর শোনা যায়, এত ক্লাব থাকতে কিংবা ম্যানইউতে ব্যাক করার সুযোগ থাকার পরেও সে জুভকে সিলেক্ট করে। যতদূর জানি, শুধু মাত্র জুভের জন্য মাদ্রিদ ১২০ এ ছাড়তে রাজি হয়। আমি সিউর যদি ওন্য কোন ক্লাব হত তাহলে পেরেজ ২০০ মিলিয়নের নিচে কখনো রাজি হত না। কিন্তু এইখানে যে রোনালদোর ও ইচ্ছে ও যে আছে। আর এইটাই হল প্রফেশনালিজম। দুইজনেই দুইজনের সমস্যাটা বুঝতে পেরেছে আর তাই দুই জনই দুইজনের ইচ্ছেকে সম্মান দিয়েছে। হা ফেয়ারওয়েল করতে পারেনি কিন্তু কেউ কাউকে বিপদে ফেলে যায় নি বরং একটা নির্দিষ্ট প্রসেসের মধ্যে তাদের নিজ নিজ পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করেছে।
তা শেষ পর্যন্ত পড়ে কি মনে হয়? দোষটা আসলে কার? উত্তর আছে robert frost এর কাছে। একবার এক ইন্টারভিউতে জিগাগস করা হয়েছিল তাকে
In all your years and all your travels what do you think is the most important thing you’ve learned about life?””
কিছুক্ষন ভাবার পরে ফ্রস্টের উত্তর ছিল,
In three words, I can sum up everything I’ve learned about life. It goes on.
আমরা সবাই সময়ের কাছে বন্দি। সেইটা রোনালদো হোক, পেরেজ হোক কিংবা আপনি আমি।