পজেশনাল সিস্টেম কি এখনো তার আসল রুপে ফিরতে পেরেছে?
ফুটবলে আমার গুরু হচ্ছেন দক্ষিনাচার্য্য। তার সাথে কিভাবে পরিচয় সেইটা নিয়ে অন্যদিন বলব। তো গুরুর কাছে আমার প্রশ্ন ছিল, “আচ্ছা পজেশনাল বেসড সিস্টেম মানেই কি টিকি টাকা?” প্রতিউত্তরে গুরু যা বলেছেন তার একটা সারসংক্ষেপ এইখানে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
পজেশনাল ফুটবল কি?
পজেশনাল ফুটবল হল একটা “ইনডিরেক্ট স্টাইল” যেইটা পুরোপুরি ফোকাস করে বল কন্ট্রোল আর শট পাসের দিকে।তবে পজেশনাল ফুটবলে শুধু শট পাসই হবে এমন কোন কথা নেই। ডাচদের “টোটাল ফুটবল” শট পাস আর লং পাসের মিশ্রণ ছিল। তাই বলা যায়, পজেশনাল ফুটবলের মূল ভিত্তি হল বল কন্ট্রোল আর পাসিং রেঞ্জ। এর সাকসেস সম্পূর্ণ নির্ভর করে আপনার হাতে কি ধরণের খেলোয়াড় আছে তার উপর। পজেশনাল ফুটবল সিস্টেমে খেলোয়াড়দের স্কিলফুল হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত কোন ম্যাচে ৫৫% এর উপর কোন দল বল পজেশন হোল্ড করলে সেই ম্যাচে বলা যায়, ওই দল পজেশনাল উইন করেছে। এখন কথা হল, বল পজেশন করাটা কেন গুরুত্বপূর্ন?
ফুটবলে হয় আপনি গোল দিবেন না হয় গোল ডিফেন্ড করবেন। এর বাইরে কোন কিছু নেই। গোল করতে চাইলে একদলকে অবশ্যি বল পোজেশ করতে হবে অপর দল তা ডিফেন্ড করবে এইটাই নিয়ম। পজেশনাল ফুটবল ব্যবহার করা হয় মূলত প্রতিপক্ষকে ওপেন করতে। তাদেরকে বাধ্য করা হয় নিজেদের পজিশন ছেড়ে উঠে আসতে কিংবা স্পেস ছেড়ে দিতে। তাই থিউরী অনুসারে, আপনি বেশি বল পোজেশ করা মানে , আপনি বেশি চান্স ক্রিয়েট করেছেন। আপনি বেশি চান্স সৃষ্টি করতে পারলে আপনার গোল করার সম্ভবনাও বেশি (এইখানে অবশ্যি আমরা বারে লাগা, কিংবা ফরওয়ার্ড মিস নিয়ে কথা বলছি না)। প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে যারা পজেশন উইন করে আমরা দেখি তারা কেন সব ম্যাচ জিতে না।
উত্তর আছে ক্রিস এন্ডারসন এর বই the number game: everything you know about soccer is wrong এ। তার ভাষ্যমতে, একজন খেলোয়াড় প্রতিপক্ষ থেকে বলের দিকে টেম্পোরলি ক্লোজ রেঞ্জে থাকাই পজেশনাল ফুটবল। এর অর্থ এই অবস্থায় আপনি শুধু বল উইন করেছেন না সাথে সাথে সময় এবং স্পেস দুইটাই উইন করেছেন। আর এই দুই ধারনার জন্য ফুটবলে এইটা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাড়ায় কোন দল আসলে কত পজেশন হোল্ড করেছে। আমরা সাধারনত যে ফুটবল পজেশনটা দেখি তা হল বেসিক্যালি আমেরিকান রিসার্চ সেন্টার ডেলটারের করা। আবার ইপিএল এই কাজটা করে অপটা স্পোর্টস নামে একটা কোম্পানী। মজার ব্যাপার হল, দুই কোম্পানিই একই ম্যাচে দুই রকম ফলাফল দেখায়। ধরুণ ডেলটার কোন ম্যাচে দেখাল টিম এ পজেশন হোল্ড করেছে ৬৮%, আবার সেইম ডেটা যখন অপটা তে দিবেন সে দেখাবে টিম এ হোল্ড করেছে ৫৭-৬০% । তার মানে দেখা যাচ্ছে, পজেশন সিস্টেমটা আমরা যতটা সহজ বলে মনে করি ব্যাপারটা মোটেও তত সহজ ব্যাপার নয়। এর কারনটা কি? কারনটা হল, পজেশন জিনিসটা নিয়ে কারো কোন ধারণা নেই। আমরা সবাই জানি পজেশন উইন করলে আমরা অবশ্যি ম্যাচ জিতব। কিন্তু কিসের পজেশন? বল? নাকি সময়? নাকি স্পেস? আর এই সবের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে ফুটবলে “হাঙ্গরিয়ান পজিশনাল বেসড ফুটবল, জোগো বনিতো, টোটাল ফুটবল, টিকি টাকা।” এই সব প্রতিটা দর্শন পজেশনাল সিস্টেমের একটা একটা সমস্যা সমাধান করে কিন্তু কোনটাই এখনো পর্যন্ত পুরো সমস্যার সমাধান করতে পারেনি।
হাঙ্গেরিয়ান পজিশন বেসড ফুটবল
নাম দুইটোর দিকে খেয়াল করুন । পজিশন এবং পজেশন। দুইতা কিন্তু সম্পূর্ন আলাদা অর্থ বহন করে। কোনটা কি জিনিস সেইটা আপনারা নিজ দায়িত্বে বুঝে নিবেন আমি ওই দিকে যাব না। হাংরিয়ান এই দলটা প্রায় সাড়ে ৩ বছর অপরাজিত ছিল। ১৯৫৪ বিশ্বকাপে সর্বপ্রথম তারা পজেশনাল সিস্টেমের একটা অংশ ডিপ্লয় করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। এইখানে মনে রাখা জরুরি যে, এর আগ পর্যন্ত সবাই কম বেশি ডিরেক্ট ফুটবল খেলতে পছন্দ করত। তো এই দলটি কি করে? তারা হাইডগুটিকে স্টাইকার হিসেবে খেলায়। আমাদের কমন পিপলের যেমন বিশ্বাস, স্টাইকার হলেই গোল দিবে কিংবা ডিফেন্ডারদের সাথে ধাক্কাধাক্কি করবে ইংলিশরা তার থেকে তেমন আশা করেছিল। কিন্তু ম্যাচ শুরু হওয়ার পর পরই তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে। যখন সে বার বার স্টাইকার পজিশন থেকে নিজেকে মিড পজিশনে নিয়ে আসছিল। আধুনিক যুগে বেনজেমা, ফিরমিনোরা যে রোল প্লে করে সেইম রোলটা প্লে করেছিল হাইডগুটি সেদিন আর ফলাফল ৬-৩। মূলত হাংরির এই সাইড দিয়ে সুচনা হয় পজেশনাল ফুটবলের। আর তাদের আইডিয়াটা ছিল পজিশন ইন্টারচেঞ্জ করে পজেশনাল উইন করা সম্ভব। হ্যা এই জন্য এখনো আমরা বারবার দেখি পজেশনাল সিস্টেমে প্লেয়াররা পজিশন ইন্টারচেঞ্জ করে।
জোগো বনিতো
পজেশনাল ফুটবলকে নতুনভাবে আবার উপস্থাপন করে ১৯৫৮-১৯৭০ এর গ্রেট ব্রাজিল দল। তবে এদের আইডিয়াটা সম্পূর্ন ভিন্ন ছিল আগের হাংরিয়ান দলের তুলনায়। এদের পজেশনটা ছিল ইন্ডিভিডুয়াল স্কিল ভিত্তিক। আমি এইখানে তাদের মূল আইডিয়াটা তুলে ধরলাম।
- ফ্রি ফ্লোয়িং মুভমেন্ট মানে হল আপনি শট পাস প্রোভাইড করবেন এবং অবশ্যি ভেরিয়েশন ব্যবহার করবেন।
- শেইপ থাকবে অটুট মুভমেন্ট সব শেইপের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে তবে কোন নির্দিষ্ট শেইপ নেই দল ভেদে শেইপ পরিবর্তিত হবে।
- উইংব্যাক আপনাকে ওয়াইড প্রোভাইড করবে পিচে।
- আপনাকে অবশ্যি স্কিলফুল প্লেয়ার হতে হবে। খুবই টেকনিক্যাল পারদর্শী হতে হবে। ড্রিবলিং, ভিশন, পাসিং এই গুলা ছিল জোগো বনিতোর মূল অস্ত্র।
- স্ট্রং মিড যেইটা আপনাকে খেলা ডিটক্টেটিং করতে সুবিধে দিবে।
এই দলটার মুল অস্ত্র ছিল তারা আক্রমনভাগকে পুরো ফ্রিডম দিয়ে দিয়েছিল। তাদের আক্রমণভাগ কখনো ট্র্যাক ব্যাক করত না। তাই স্টাইলটাই ফ্লুয়েড হলে ও পুরো ফ্লুয়েড হচ্ছিল না। আর যেহেতু ড্রিবলিং করার প্রবনতা এই সিস্টেমে আছে। তাই বল পোজেশন হারানোও সম্ভবনাও বেশি। অন্যদিকে, কতক্ষন কে পায়ে বল রাখবে এইটা নিয়েও কোন ধারণা ছিল না কারো। নেইমার সে স্কিল শো করতে চায় তার কারণ কিন্তু এইটাই। সে নিজে ও জানে না তাকে কতক্ষন সময় দেওয়া হয়েছে বল হোল্ড করার। তবে এই সিস্টেম থেকে ৩ টা আইডিয়া পরবর্তীতে পজেশনাল ফুটবলে আসে । আর তা হল ফুলব্যাক অথবা উইংব্যাক দিয়ে পিচে ওয়াইড প্রোভাইড করা এবংপজেশনাল ফুটবলের জন্য টেকনিক্যাল সম্পন্ন প্লেয়ার লাগবে। সব শেষে, মিড দিয়ে কন্ট্রোল সিস্টেম।
টোটাল ফুটবল
জোগো বনিতোর পর যে স্টাইলটা সব থেকে বেশি প্রভাব ফেলেছে ফুটবলে ওই সময় তা হল “টোটাল ফুটবল”। এই সিস্টেমের মূল ভিত্তি ছিল ফুল ফ্লুয়েডিটি এবং এই সিস্টেমই প্রথম ধারনা আসে পজেশন উইন ইন স্পেস। এই সিস্টেমে আপনাকে সব পজিশনেই খেলার পারদর্শী হতে হবে। মাঠে আপনার কোন নির্দিষ্ট পজিশন নেই। আপনি শুধু স্পেস খুজবেন। আর বেটার পজিশনে থাকা প্লেয়ারকে বল পাস দিবেন। তারমানে দেখা যাচ্ছে, এই টোটাল ফুটবল হাঙ্গেরিয়ান পজিশন সিস্টেম থেকে তাদের ইন্টারচেঞ্জ ধারনাটা নিজেদের মধ্যে নিয়ে এসেছে। আবার জোগো বনিতোর শেইপকে পুরোপুরি ত্যাগ করেছে। (ফল করার একটা কারন ও হল এই শেইপহীন খেলা।) এই ধারণা পজেশনাল সিস্টেমকে নতুন ভাবে প্রভাবিত করে। আস্তে আস্তে সবাই বুঝতে পারে স্পেসের গুরুত্ব কতখানি ফুটবলে। টোটাল ফুটবলের ক্রেডিট সবাই ক্রুইফকে দিলেও এর জনক কিন্তু রাইনুস। এবং সে সর্ব প্রথম তুলে ধরে ব্রাজিলে ৪-২-৪ সিস্টেমতা এতটা ফ্লুয়েড না আর তার হাত ধরেই শুরু হয় আধুনিক ফুটবলের ৪-৩-৩ পজেশন বেসড সিস্টেম। তার দলে গোলকিপারও একজন লিবারো হিসেবে ব্যবহৃত হত। কিন্তু এই সিস্টেমেও আগের ৩ সিস্টেমের মত সমস্যা থেকে গেল আর তা হল, বল পজেশন উইন হচ্ছে টা কিসে? তার কোন ধারণা নেই। একবার সে বলেছিল, উইনটা হচ্ছে স্পেস ডমিনেট করছে দল। কিন্তু প্রতিপক্ষ যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে আপনাকে স্পেস ডমিনেট করতে দেয় তখন কি হবে?
টিকি টাকা
টিকি টাকা কি কিভাবে খেলে এইগুলা নিয়ে অনেক আর্টিকেল এবং বিভিন্ন গ্রুপে অনেক লেখা আছে। আমি বরং ফোকাস করব এইটাকে কেন টোটাল ফুটবলের সাথে তুলনা করা হয়। আমি উপরে বলেছি টোটাল ফুটবল ফলের একটা মূল কারণ ছিল তাদের শেইপহীন খেলা। টোটাল ফুটবল ছিল প্লেয়ারদের মুভমেন্ট কিন্তু টিকি টাকা হল বলের মুভমেন্ট। টোটাল ফুটবলে আপনি বল পাস করে মুভ করবেন স্পেসে এবং বল প্রোভাইড করা হবে সেই স্পেসে। টিকি টাকা হল প্লেয়াররা নিজেদের মধ্যে পজিশন ইন্টারচেঞ্জ করতে পারবে কিন্তু শেইপটা মেইনটেইন করবে এবং বলটা যতটা সম্ভব নিজেদের পায়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে । বল না পেলে প্রতিপক্ষ এক সময় টায়ার্ড হয়ে ভুল করবে আর সে সময় সুযোগ নিতে হবে আপনার। কিন্তু এই টিকিটাকা এক সময় ডিফেন্সিভ ট্যাকটিসে পরিণত হয়ে যায়।আপনি গোলে এগিয়ে থাকলে বল রোটেড করা খুবই সহজ একটা ব্যাপার কারন আপনার হাতে টেকনিক্যাল প্লেয়ার আছে এবং দলের সবাই বল পায়ে ভাল।সমস্যাটা হয় গোল না পেলে কি হবে? আমাদের যে বর্তমান ধারণা বল পজেশন উইন করা মানেই পজেশনাল ফুটবল এইটাই এই টিকি টাকা থেকে নেওয়া। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, এই টিকিটাকা অ তার রুট টোতাল ফুটবলের মত সেইম ক্রাইসিসে ভুগছে। আপনাকে যদি উইনলিংলি প্রতিপক্ষ বল পোজেশ করতে দেয় তখন আপনি কি করবেন? বল কি পজেশ করবেন নাকি না?
উপরোক্ত ৪টা বাদে ও অনেক পজেশনাল সিস্টেম আছে কিন্তু এইগুলায় বেশি প্রভাবিত করেছে ফুটবলকে। তা আমরা এতটুকু পড়ে কি বুঝলাম? পজেশনাল সিস্টেম আসলে কি জিনিস সেইটা সম্পর্কে এখনো কারো ধারনা নেয়। পজেশন উইন বলতে আগের ফিলোসফরা সবাই নির্দিষ্ট একটা কাজ উইন করাকে বুঝায় যেমন কেউ স্পেস কেউ বল কেউ বা পজিশন কেউ বা সময়। আরো সহজে বলতে আপনি যদি সময়,স্পেস, বল এবং পজিশন এই ৪টায় একসাথে উইন করতে পারবেন তবে তখনই সেইটাকে সাকসেসফুল পজেশনাল সিস্টেম বলা যেতে পারে।
আর তাই সবার হাতে এখনো সুযোগ আছে পজেশনাল ফুটবল নিয়ে কাজ করার। আইডীয়া গুলোকে আর মডিফাই করার। সব শেষে ক্রুইফের কথা দিয়েই শেষ করি ,
Playing football is very simple, but playing simple football is the hardest thing there is.