কেমন আছে পেপের টিকিটাকা?
আধুনিক ফুটবলে সব থেকে আলোচিত কিংবা সমালোচিত ট্যাকটিস হল টিকি টাকা। বর্তমান সব পজেশনাল বেসড কোচই যে এই ট্যাকটিস থেকে অনুপ্রানিত তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সদ্য শেষ হওয়া বিশ্বকাপে পজেশনাল ফুটবলের ভরাডুবি হলেও আগাম ভবিষ্যতে এই পজেশনাল ফুটবলই যে ডমিনেট করবে তা বলা শ্রেয়।
তা এই টিকিটাকার জনক দাতা কি ভাবছেন তার ট্যাকটিস নিয়ে? গার্দিওলা নিজেই জনক হলেও তার নিজেরই টিকিটাকা নিয়ে বিরুপ ধারনা আছে। কেন সেইটা আমরা দেখতে পারব আস্তে ধীরে।
টিকি টাকার মূল ভিত্তি ছিল কুইক শট ডিরেক্ট পাসিং। যত মিনিমাম কম ভুল করা যায় পাসিং এর ক্ষেত্রে। পাসিং ভার্টিকেল ও হতে পারে হরিজন্টালও হতে পারে। যেহেতু বল ধরে রাখা লক্ষ্য তাই হরিজন্টালই বেশি প্রাধান্য।এইটাই খেলাটাকে স্লো করে ফেলে। আর সে সময় পজেশন ধরে রাখার জন্য ব্যবহৃত হত ট্রায়াঙ্গল। তার ৪-৩-৩ ফরমেশন পুরো মাঠে ট্রায়াঙ্গল সৃষতি করতে সমর্থ হয়েছিল। মাঠের যে কোন পজিশনে তার অতিরিক্ত একজন খেলোয়াড় থাকত পাসিং অপশন হিসেবে । কী পয়েন্ট ছিল ৩ টা। মানে হল একজন বল প্রোভাইডার পাস দেওয়ার জন্য সব সময় ৩ জনকে পাবে তার আশে পাশে এরমধ্যে থেকে তাকে বেস্ট অপশনটা খুজে নিতে হবে। তার এই তত্ত্ব কাজে লেগেছিল কারণ সে সময় তার হাতে ছিল সময়ের অন্যতম সেরা ৩টা মিড আর মেসি। লা মেসিয়ায় একসাথে খেলার সুবাদে তাদের মধ্যে বোঝাপড়া ছিল অন্য রকম। জাভির একুরেট পাসিং, ইনিয়েস্তার ভিশন, বুসকেটসের হোল্ড আপ প্লে, আর মেসির ফিনিশিং সব মিলিয়ে টিকিটাকার জন্য পারফেক্ট একটা কম্বো ছিল। তবে এই ৪ জনের বাইরে ও একজন ছিল যার উপস্থিতি টিকিটাকাকে পরিপূর্নতা দেয়। পাশাপাশি টিকি টাকার উইক লিংকটাও সবার কাছে আস্তে আস্তে তুলে ধরে। তো সেইটা কে ??
রাইট ফুলব্যাক । দানি আলভেজ। টিকিটাকা দলের অন্যতম অপরিহার্য সদস্য। টিকিটাকার অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্য হল প্লেয়ারদের ভিন্ন ভিন্ন পজিশনে খেলার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। আর এই জন্য বার্সাতে তখন ফুলব্যাকরা বক্স টু বক্স মিড হিসেবে ব্যবহৃত হত। আলবা আলভেজের মত আক্রমণাত্মক ছিল না । অন্যদিকে আলভেজ সব সময় আক্রমণ করতে পছন্দ করত। কখনো ওয়াইড প্লেয়ার হিসেবে ক্রস করত কখনোবা উইংগারদের মত কাট ইন করত। গার্দিওলা তার প্লেয়ারদের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিল মঠে রোমিং করার। তাছাড়া আলভেজের অস্বাভাবিক স্টামিনার জন্য সে সময়মত এসেও ডিফেন্ড করতে পারত। কিন্তু তার এই উপরে উঠে যাওয়ার স্বভাবটা আস্তে আস্তে টিকি টাকার দূর্বলতা হিসেবে দেখতে আপ্য। খেয়াল করলে দেখবেন এল ক্ল্যাসিকোতে মাদ্রিদ সব সময় বার্সার এই উইক লিংক টাকে টার্গেট করত। যার জন্য পিকেকেই সব সময় রোনালদোর গোল দেখতে হত। কারন আলভেসের ফেলে আসা স্পেস কভার করার দায়িত্ব ছিল তার। আর এই জন্য বার্সার সাথে কার ম্যাচ হলেই ওই সময় তারা উইং নির্ভর খেলা খেলত। দুইটি স্পিডি উইংগার প্রভাইড করলে বার্সার ডিফেন্সে সমস্যা দেখা দিত। তার উপর বার্সা খেলত হাই ডিফেন্স লাইন এতে যেমন সুবিধে ছিল তেমনি অসুবিধেও ছিল। অসুবিধের কথাতা তো বললামই। সুবিধে ছিল খুব সহজে প্রতিপক্ষকে আউটনাম্বার করা যেন পজেশন হারিয়ে ফেললে। আর আলভেজ, আলবার পিচ হাই আপ তাদেরকে দুই জায়গাতেই নিউমেরিক্যাল সুপুরিওটি ও এনেছিল।
বার্সায় পেপের ট্যাকটিস সম্পূর্ন রকম সাকসেস ছিল এই ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশ করার মত কেউ আছে মনে করি না। সমস্যাটা শুরু হয় বায়ার্ন যাওয়ার পর থেকে । ফিলিপে লাম একজন লিজেন্ডারি রাইটব্যাক কিন্তু সে আলভেসের মত রোমিং মিডফিল্ডার না। তার উপর বায়ার্নে কোন ফলস ৯ নেই। যে কিনা মেসি রোল প্লে করবে। আর এই সমস্যা সমাধানের জন্য পেপ ৪-১-৪-১ ফরমেশনে শিফট করে যেখানে লামকে বানানো হয় ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার তাকে নিউম্যারিক্যাল সুপিওরিটি এনে দিয়েছিল মিড ফিল্ডে। কিন্তু সেইটি শুধু রাইটব্যাকেই। এই ট্যাকতিস বুন্দিসলীগায় সাকসেসফুল হলেও মারা খেয়ে যায় উচলে। এর মূল কারণ ওই যে ফলস ৯। বায়ার্নে লেওয়াডস্কি স্পেস শেয়ার করতে পছন্দ করে না। কারণ সে ক্লাসিক নাম্বার ৯ আবার অন্যদিকে রোবেন কাট ইন করে ঢুকতে পছন্দ করে বটে কিন্তু সে কিংবা রিবেরী দুইজনের কেউ সেন্ট্রাল এরিয়া দখল করতে ইচ্ছুক না। তাই বার্সার সময় টিকি টাকা যে রকম ফ্লুয়েন্ট ছিল বায়ার্নে সেইটা দেখা যায় না । আর পজেশনাল ফুটবলে একজন রোমিং ৯ আলাদা এডাভান্সটেস দেয়। শুধু মাত্র বল পজেশন ধরে রাখার জন্য না। প্রেসিং এর সময় আপনি একজন অতিরিক্ত প্লেয়ার পান বল উইন করার জন্য। তবে সেই হিসেবে বলা যায়, পেপের ট্যাকটিস বায়ার্নে তেমন সুবিধে করতে পারেনি। সুবিধে করতে না পারলেও এইটা পেপকে আরো বাস্তববাদী করে তুলে । যেইটার প্রতিফলন পাওয়া যায় ম্যানসিটিতে।
অন্যদিকে বার্সা তখনো টিকিটাকা চালাচ্ছিল। তবে একটু ভিন্নভাবে। এইবারের আগের থেকে ডিরেক্ট এপ্রোচ। আগে সবার রোমিং করার কথা থাকলেও এখন শুধু মাত্র ফ্রন্ট ৩ কে সেই স্বাধীনতা দেওয়া হল। ইনিয়েস্তা, জাভি সরাসরি পাস দিত এম এস এন জুটিকে। এই জুটি ফ্রন্ট লাইনে খুবই বিপদজনক। ৩ জনেই প্লেমেকিং+গোল করতে পারত। যেইটা বার্সাকে অনন্য জায়গায় নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিল। তবে জাভির অবসরের পর আস্তে আস্তে স্থিমিত হয়ে আসে টিকি টাকা। টিকিটাকার যে মূল ভিত্তি তার কোর অংশেই ছিল জাভির একুরেট পাসিং স্কিল। তাই তার অবসর বার্সা ক্যাম্পে টিকিটাকা তে বের হয়ে আসার জন্য যথেষ্ট ছিল।
এইদিকে ম্যানসিটির দায়িত্ব নিয়ে ফেলে পেপ। সবার মত আমারও সন্দেহ ছিল কতটুকু সাকসেস করবে পেপের টিকিটাকা ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে। প্রথম সিজনে টপ ৪ এ শেষ করে প্রশ্নটা আরো কঠিন করে তুলে পেপ নিজেই । তবে না দ্বিতীয় সিজনেই পেপ আবার তার ম্যাজিক দেখায়। আর এইবার সে ইমপ্লিমেন্ট করে বায়ার্ন থেকে নিয়ে আসা ইনভার্টেড ফুলব্যাক তত্ত্ব। আর এইবারের ফুলব্যাকটি আগের থেকে আরো বেশি কার্যকর।
তো ম্যানসিটিতে ইনভার্টেড ফুলব্যাক তত্ত্বটি কিভাবে কাজ করে। ওয়েল বেসিক প্রিন্সিপাল একই। মিডে নিউম্যারিক্যাল এডভান্টেজের জন্য এইটি ব্যবহৃত হয়। পাশাপাশি প্রতিপক্ষের প্রেস ব্রেক করার জন্য। তা কিভাবে? চলুন দেখে আসি।
যদি প্রতিপক্ষ ফুলব্যাককে প্রেস করে তবে ফুলব্যাক চেষ্টা করে যতটা সম্ভব ওয়াইড এরিয়াতে চলে যেতে তাহলে মিড থেকে ব্রুইন অথবা সিলভা এসে বল রিসিভ করে প্রেস ব্রেক করতে পারবে। একপাশের উইংগার তখন সেন্ট্রাল এরিয়াতে চলে আসে। আর তার ফেলে আসা স্পেস কভার করে ওই ফুলব্যাক। এতটুকু পর্যন্ত বার্সা স্টাইল। কিন্তু যখন দেখা যায়, ফুলব্যাক মার্ককৃত অবস্থায় নেই। এবং ওয়াইড প্লেয়ার খুব সহজে ওয়াইড এরিয়া কভার দিতে পারছে। তখন ফুলব্যাকরা ইনঅসাইডে কাট করে ওয়াইড এরিয়ার জন্য পাসিং অপশন এবং ডিফেন্স দুইটাই ব্যালান্স রাখতে সাহায্য করে। আর তখনই তার নাম হয়ে যায় ইনভার্টেড ফুলব্যাক। এর ফলে ফুলব্যাক এখন হাফ স্পেসের দখল নিতে পারবে। এবং চাইলে এইখান থেকে গেইম কন্ট্রোল করতে পারবে।
এইবার আসি, ম্যানসিটির ফলস ৯ ট্যাকটিসে। গার্দিওলার সব থেকে বড় সাফল্য ছিল এই ফলস ৯ ট্যাকটিস। মেসিকে এল ক্ল্যাসিকোতে খেলিয়ে ফলস৯ ট্যাকটিসের সূচনা করে গার্দিওলা। এই ট্যাকটিসটা আমার পারসোনালি খুবই পছন্দের। এর কারণ হল, এইটা শুধুমাত্র আপনাকে মিডে নিউম্যারিক্যাল সুপিরিওটি এনে দেয়া না পাশাপাশি, আপনার দলে বিভিন্ন স্কোরার তৈরীতে সাহায্য করে।
তবে ফলস ৯ ট্যাকটিস বোঝার আগে আমাদের বুঝা লাগবে ক্লাসিক ৯ আর এর মধ্যে পার্থক্য কি। কেনই বা বায়ার্নে পেপকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়েছিল। ক্লাসিক ৯ লেওয়া কিংবা হালের লুকাকুকে আমরা বিবেচনা করতে পারি। আগের যুগে নাম্বারের উপর প্লেয়ারদের খেলার ধরণ নির্ভর করত। আধুনিক ফুটবলে এইগুলার তোয়াক্কা করা হয় না। তো যা বলছিলাম। ক্লাসিক নাম্বার ৯ এর কাজ হল। বল উইন কর। গোল দাও। তারা শারীরিকভাবে খুবই শক্তিশালী হয়। এরা যে কোন ভাবেই বল উইন করবে এই রকম মেন্টালিটি টাইপের হয়। সহজ কথায় ক্লাসিক ৯ এর কাজ হল গোল দেওয়া । দল তার জন্য খেলা বিল্ড করবে সে শুধু ফিলিশিং টাচটা দিবে। কিন্তু ফলস ৯ এইখানে সম্পূর্ন রকম ভিন্ন। ফলস ৯ কে গোল দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় না। মূলত ব্যবহার করা হয় মিডে ডমিনেট করার জন্য। কোনভাবেই যাতে মিডের কন্ট্রোল না হারায় আরো ভালভাবে বলতে বল হারালেও যাতে এনাফ ম্যান এডভান্টেজ থাকে বল উইন করার জন্য। আর এইকাজটা সব থেকে ভালভাবে এখন পর্যন্ত করতে পেরেছে মেসি। তার এত গোলের জন্য সাধারনত মানুষ বুঝতে পারে না মেসি কি গোল স্কোরার নাকি মিডফিল্ডার। প্রশ্নও সৃষ্টি হয়, ফলস ৯ কি একজন মিডফিল্ডার যে অনেক গোল করে। নাকি একজন স্টাইকার যে কিনা মিডফিল্ডে খেলে।
তাছাড়া আরো একটা প্রশ্নও তৈরী করে গিয়েছিল গার্দিওলার ফলস ৯ ট্যাকটিস কি অন্য কাউকে দিয়ে করতে পারবে? উত্তর হল হ্যা করতে পারবে তবে একটু ভিন্ন ভাবে।
ম্যানসিটিতে মেসি ছিল না তাই পেপকে নির্ভর করতে হত ট্যাকনিক্যালি দক্ষ প্লেয়ারের উপর। তাদের খেলা যারা ফলো করেন তারা দেখবেন মাঝে মাঝে যখন চান্স ক্রিয়েট করা সম্ভব না হলে জেসুস ওয়াইড এরিয়ায় চলে যায় আর তার জায়গাটা নেয় স্টার্লিং। স্টার্লিং সেন্টার এরিয়া দখল করলে আস্তে আস্তে মিডের কন্ট্রোল বাড়তে থাকে সিটির। এমতাবস্থায় আমাকে বলুন, ফলস ৯টা কে এইখানে? স্টার্লিং নাকি জেসুস?
স্টার্লিং অতিরিক্ত মিড ফিল্ডার হিসেবে খেলছে মেসির কত ।আবার জেসুস গোল দিচ্ছে মেসির মত। আপনার হাতে মেসি না থাকলেও এই দুইজনের কম্বিনেশন আপনাকে মেসির কাজটা করে দিচ্ছে। এবং এইটা খুবই ভাইটাল একটা পরিবর্তন বলে আমি মনে করি। এইটা শুধুমাত্র ফলস ৯ সম্পর্কে আরো নতুন ধারনার জন্ম দেয়নি পাশাপাশি এর কার্যকারিতা কে নতুন মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে।
তো এই সবই ছিল পেপের টিকিটাকার বর্তমান অবস্থা। টিকিটাকা ক্রমাগত বিবর্তিত হচ্ছে । কখনো বা পেপের হাত ধরে কখনো বা অন্য কোন কোচের হাত ধরে। হয়ত নতুন কোন কোচের অধীনে সম্পূর্ন নতুন কোন নাম দিয়ে আমরা টিকিটাকার মডিফাই ভার্সন দেখতে পারব শীঘ্রই।