লুকা মদ্রিচ এনালাইসিস
২০১৩ সালে স্পেনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মার্কা লালিগা সাইনিং এর উপর একটি জরিপ প্রকাশ করে যেখানে দেখা যায় ৩২% মাদ্রিদস্তারা সব থেকে বাজে সাইনিং হিসেবে অভিহিত করে লুকা মদ্রিচকে। আজ ৫ বছর পর যখন মাদ্রিদস্তারা অতীতে ফিরা থাকায় তখন তারা বুঝতে পারে কি ভুলটাই না তারা ভেবেছিল এই লিকলিকে গড়নের বাচ্চাটাকে। আমার এই লেখায় আমরা বুঝার চেষ্টা করব কেন মাদ্রিদ তাকে সিলেক্ট করেছিল আর কিভাবে সে নিজেকে দিনের পর দিন সেরাদের কাতারে তুলে আনল।
মদ্রিচকে কেন নেওয়া হয়েছিল সেইটা দেখতে হলে আমাদের দেখা লাগবে সেই সময়ের আমাদের সিস্টেমের কি সমস্যা ছিল। মরিনহোর মাদ্রিদ তখন ৪-২-৩-১ ফরমেশনে খেলতে অভ্যস্ত। কিন্তু এই ফরমেশনে কিছু সমস্যা ছিল মরিনহোর আর তা হল গোলে চান্স ক্রিয়েশন।মরিনহোর দল পুরোপুরি গোলের জন্য ওই সময় রোনালদোর একক নৈপুন্যর উপর নির্ভর ছিল। আর এই সমস্যটা আরো প্রকট হয়ে পড়ে যখন দেখা যায়, আমাদের বেঞ্চ এতটা শক্তিশালী না। ডি মারিয়া কোন ম্যাচ অফ থাকলে মাদ্রিদে চান্স সৃষ্টি করার জন্য স্কোয়াডে তখন প্লেয়ার নেই। আর তাই ‘১২ সিজন থেকে মারিয়াকে মরিনহো উইংগারে শিফট করে আর ডিফেন্সিভ স্টাবিলিটির জন্য ব্যবহার করা হয় ডিয়ারা অথবা খেদিরাকে। কিন্তু এদের কেউ আক্রমনাত্মক মাইন্ডেড না। সমস্যা প্রকট হয়, লো ব্লক দল গুলোর সাথে। মরিনহোর মাদ্রিদ পিছিয়ে থাকলে তাদের হাতে অপশন কম ছিল খেলার পেস বাড়ানোর। এক ম্যাচে তো ডিয়ারাকে তুলে বেনজেমাকে নামাতে বাধ্য হয় মরিনহো চান্স ক্রিয়েহসনের আশায়। এইদিকে গেটাফে এবং ভ্যালেন্সিয়া দুই দলই একই এপ্রোচ গ্রহন করে মাদ্রিদের বিপরীতে। আর সেইটা হল কাউন্টার। ওজিলের সমস্যা ছিল, ওজিল কখনো ৯০ মিনিট প্রেস করতে পারত না। পাশাপাশি তাকে খুব সহজে ডিসপোস করতে পারত বিপরীত দল। আর তার ট্র্যাক ব্যাক করার রেকর্ডও তেমন ভাল নয়।কিন্তু মরিনহোর সিস্টেমে এটাকিং মিডফিল্ডের ওয়ার্ক রেইট বেশি হওয়াটা জরুরী। আক্রমনভাগে ১০০% সফল হলেও ডিফেন্সিভ পার্টে ঠিক ততটাই দূর্বল ওজিল। আর এই সব সমস্যা সমাধানের জন্যই মূলত মদ্রিচকে আনা। মদ্রিচ মাদ্রিদ সিস্টেমের ৪টা গুরুত্বপূর্ন জায়গায় খেলতে পারে আর তাই এই ভার্সেটাইলিটি গুণই মরিনহোকে আকর্ষণ করে মদ্রিচের প্রতি। মদ্রিচের ভার্সেটাইল নেচার ম্যাচের যে কোন পজিশনে কোচকে তার ফরমেশন পরিবর্তন করতে সাহায্য করে পাশাপাশি তার “দলের জন্য খেলা” স্বভাব তাকে আউট অফ পজিশনে খেলিয়েও ভাল আউটপুট পাওয়া যায় তুলনামূলক অন্যদের থেকে। মুলত মদ্রিচকে দিয়েই মাদ্রিদ তাদের ৪-২-৩-১ সিস্টেম থেকে আস্তে আস্তে ৪-৩-৩ সিস্টেমে শিফট করে।আর এই ৪-৩-৩ সিস্টেমের জন্য আমাদের ওই সময় দুইটা পজিশন ছাড়তে হত। ১। ডিমারিয়া ২। ওজিল। যেহেতু ডি মারিয়ার ডিফেন্সিভ ওয়ার্করেইট ভাল ছিল পাশাপাশি ওয়াইড রোলটা ওজিল থেকে ভাল প্লে করতে পারত তাই পরবর্তীতে মাদ্রিদ মারিয়াকে রেখে ওজিলকে বেচে দেয়।
মদ্রিচের সব থেকে বেস্ট আউটপুট দেয় সেন্ট্রাল মিডফিল্ড পজিশনে। আমি এইখানে একজন বেস্ট সেন্ট্রাল মিডফিল্ডের কি কি গুন থাকে সেইটা বলব না বরং আমি মদ্রিচকে দেখাব আপনারা বাকীটা ভেবে নিবেন। মদ্রিচের সব থেকে বড় গুন তার প্রেস রেসিটেন্স ক্ষমতা। গত উচল ফাইনালের লিভারপুলের বিপক্ষে ম্যাচটা দেখলেই বুঝবেন তার প্রেস রেসিস্টেন্স ক্ষমতা কেমন।আপনি তাকে টানা প্রেস করে যেতে পারেন বরং সে প্রেশারটা এবজর্ব করতে পছন্দ করে। তার ফার্স্ট টাচই তাকে সাহায্য করে প্রেশার রিলিজ করতে অথবা প্রয়োজনভেদে প্রেস ব্রেক করার জন্য সে ড্রিবল ব্যবহার করে। জিদানের মাদ্রিদ সাধারণত টনি ক্রুসকে ডিপ লাইয়িং প্লে মেকার হিসেবে ব্যবহার করে কিন্তু কোন কারণে ক্রুসের অফ ডে গেলে কিং প্রেশার বিল্ড হলে সেই বাটনটা চলে যায় মদ্রিচের হাতে।
টনি ক্রুসের পর মাদ্রিদে সব থেকে বেশি পাস একুরেসি মদ্রিচের। আর তার ভান্ডারে আছে শট পাস, লং পাস, লব পাস থেকে শুরু করে সব কিছুই। আর এইজন্য মদ্রিচকে প্রেস করতে করতে প্রতিপক্ষকে উপরে উঠে আসার স্বভাব দেখা যায়।এই সময় সে ব্যবহার করে তার লং পাস এবিলিটি যেইটা এটাকারদের রানিং বিহাইড দ্যা ডিফেন্সের সুবিধা নিতে সাহায্য করে।তাছাড়া তার থ্রু পাস গুলো বেশিরভাগ সময় এটাকারদের ১ বনাম ১ সিচুয়েশনের সৃষ্টি করে। আর তাকে প্রেস না করলে হয় সে সুইচ প্লে করে অথবা বল নিয়ে নিজে সেন্টার এটাকিং পজিশনে চলে আসে। মদ্রিচের এই বিভিন্ন ধরণের পাসিং রেঞ্জ তাকে ডমিনেটেড মিডে পরিণত করেছে আর এটাকারদের শুধু ফিনিশিং আর প্রতিপক্ষের বক্সের এর দিকে ফোকাস রাখতে সাহায্য করে।
স্পেস রিকগনাইজেশন যে কোন ফুটবল প্লেয়ারের জন্য গুরুত্বপূর্ন। মিডফিল্ডারদের স্পেস রিকগনাইজ করাটা জরুরী। মদ্রিচ এই কাজটা বারবার করে । সে শুধু স্পেস খুঁজেই পায় না । উলটো তার টিমমেইটদের জন্য স্পেস বানিয়ে দেয়। কোন জায়গায় সে স্পেস খালি দেখলে হয় সে ড্রিবল করে না হয় ওই স্পেসেই বল নিয়ে দৌড়ায় অথবা প্রতিপক্ষকে সাইডে নিয়ে আসে যাতে দলের অন্য সদস্যরা স্পেস ব্যবহার করতে পারে।
মদ্রিচের থার্ড স্পেশাল যেইটা আমার বেশি ভাল লাগে তা হলে রোল পরিবর্তিত হলে সে তার সম্পুর্ণ খেলাও পরিবর্তন করে ফেলে। এটাকিং মিডে তাকে প্রেস করা হলে সে সাধারণত থ্রু বল খেলতে অভ্যস্ত আর সাথে রেডি হয়ে যায় ডিফেন্সিভ ডিউটি পালন করার জন্য। অন্যদিকে সেন্টার মিডে প্রেশার অনুভর করলে সে সিকিউর পাস দিতে অভ্যস্ত।
মদ্রিচের আরেকটি দেখার বিষয় হল লিংক আপ প্লে। মদ্রিচ ওয়ান টাচ ফুটবল খেলতে অভ্যস্ত। একটা ভাল ফুটবলারের এই গুনটা থাকা অবশ্যম্ভাবী। তার ওয়ান টাচ ফুটবল শুধু দলের বিল্ড আপ করতে সাহায্য করে না বরং এক পাসে সে আক্রমণের সুচনা ও করতে পারে। আর এই পাসের ভয়াবহতা বাড়ে যদি ট্রাঞ্জিশন পিরিয়ডে থাকে খেলা।
মাদ্রিদ দলে এখন পর্যন্ত আমার মতে একমাত্র প্লেয়ার হল মদ্রিচ যে কিনা খেলার টেম্পো বিল্ড করতে পারে। খেলার টেম্পো কন্ট্রোল করাটা একজন মিডফিল্ডারের ক্যারিয়ারে প্লাস পয়েন্ট। এইটা শুধু তাকে খেলোয়াড় হিসেবে নয় পরবর্তীতে কোচ হিসেবে ও অনেক সুবিধে দেয়। খেলার টেম্পো বলতে আমরা বুঝি কখন খেলা স্লো করা, কখন হোল্ড প্লে করা কখন আক্রমণে যাওয়া, কখন খেলা রিস্টার্ট করা। আর এই কাজটা খুব দক্ষভাবে করে মদ্রিচ। যদি সে বুঝতে পারে সে আউটনাম্বার হয়ে গিয়েছে কিংবা পজিশনাল কট খেয়েছে তখন তার টার্গেট থাকে দুইটা হয় খেলা স্লো কর না হয় খেলাটা নষ্ট কর যাতে রিস্টার্ট করতে পারে। মদ্রিচ সাধারণত আউটনাম্বার হয়ে গেলে রিস্ক ফ্রি জায়গায় গিয়ে হোল্ড প্লে করতে পছন্দ করে। আবার ঠিক উলটা কাজটাই করে তার ডিফেন্সিভ ডিউটির সময়। প্রতিপক্ষের কাউন্টারে সে পজিশন ভেদে সিদ্ধান্ত নেয় তাকে প্রেস করবে নাকি অপেক্ষা করবে বাকীদের জন্য।প্রেস করলে তার পুরো ইনটেনশন থাকে বল উইনের ব্যাপারে। তবে মিড কট খেলে সে সরাসরি প্রেস করে না। বরং সাইড প্রেস দিয়ে ওয়েট করে বাকী সবাই যাতে নিজেদের পজিশনের কভার নিতে পারে। মোট কথা, মদ্রিচ খেলার সময় শুধু মাদ্রিদের কথায় ভাবে না । বরং প্রতিপক্ষের সম্ভাব্য গেইম প্ল্যানের কথাও সে ভেবে নেয়।
মদ্রিচ কে নিয়ে বললে যেইটা না বললেই নয় তা হল ওয়ার্ক রেইট, স্টামিনা । কার্লো, জিদান দুইজনের কাছেই তার এত গ্রহনযোগ্যতার কারণ ওয়ার্ক রেইট আর ১২০ মিনিট খেলার স্ট্যামিনা। এই বারের বিশ্বকাপে পর পর ৩ টা ম্যাচ ১২০ মিনিট খেলেও ফাইনালে সব থেকে বেশি রিফ্রেশ ছিল মদ্রিচ এবং তার বয়স এখন ৩২। প্রতি ম্যাচে সেন্টার মিডের সব জায়গা সে কভার করে থাকে। তার এই হার্ড ওয়ার্কিং নেচারের সাথে আছে গেইম ইন্টালিজিন্সি। যেইটা তাকে আরো দূর্বোধ্য করে তুলে প্রতিপক্ষের কাছে। প্রবাদ আছে,”ট্যালেন্টের সাথে হার্ড ওয়ার্ক থাকলে তাকে আটকানো যায় না”। মদ্রিচের বেলায় এই প্রবাদটি অক্ষরে অক্ষরে খাটে।
আমি পারসোনালি মদ্রিচের বল কন্ট্রোলের বিশাল বড় ফ্যান। তার বল কন্ট্রল লেভেল অসাধারণ। শুধু মাত্র বল কন্ট্রোল করতে গিয়েই সে প্রেশার রিলিজ করে ফেলে। তার বল কন্ট্রোলের বর্নণা লেখাতে বিবরণ করা সম্ভব নয়। এর জন্য অবশ্যি আপনাকে ইউটিউবে অথবা টিভিতে বসে খেলা দেখতে হবে।
এইবার আবার ফিরে আসি সিস্টেমে। মাদ্রিদে সাধারনত তাকে এটাকিং মিডে খেলতে খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু এটাকিং মিড হিসেবে মদ্রিচের আউটপুট কেমন সেইটা এইবার বিশ্বকাপ দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবেন। ক্রোয়াশিয়া দলে চান্স সৃষ্টি করার মত সহজ কথায় প্লে মেকিং করার মত কোন প্লেয়ার নেই। আর এই জন্য মুলত ডালিচ মদ্রিচকে উপরে তুলে আনে। মদ্রিচ হাফস্পেসে ব্যবহার করতে পারে খুব ভাল ভাবে। যেই কারণে মূলত সে ৪ টা বিভিন্ন ধরনের পজিশনে খেললে ও তার সমসয়া হয় না। আর এই হাফস্পেসটা খুবই গুরুত্বপূউরণ প্রতিপক্ষের ডিফেন্স ব্রেক করতে । সাধারণত প্রতিপক্ষ সেন্টার আর ওয়াইড এরিয়া কভার দেয় এটাক বন্ধ করার জন্য। তাই হাফ স্পেস চ্যানেলটা মোটামুটি বলা যায় সব সময় ওপেন থাকে। ,
এইখানে মনে রাখা জরুরি যে, মদ্রিচ মিডের সব পজিশনে খেলতে পারলেও তাকে ডিফেন্সিভ ডিউটি থেকে যত দূরে রাখা যায় ততই দলের জন্য ভাল। এর কারণ হল, ডিফেন্স নিয়ে তার যত কম চিনতে করা লাগবে আক্রমণে সে তত ভাল আউটপুট দিবে।
সব শেষে আমাদের সমর্থকদের সাইনিং ক্লাব এই সব নিয়ে অনেক ধরণের কথা বলতে শুনা যায়। তবে ম্যাকেলেলে ইনসিডেন্ট বাদ দিলে এখন পর্যন্ত যাদের ক্লাবে আনা হয়েছে তাদের প্রতিটার পিছনেই কোন না কোন কারণ ছিল। তাকে বাজে সাইনিং তগমা দেওয়ার কারণও ছিল সে গোল, এসিস্ট তেমন পাচ্ছিল না যতটা সমর্থকরা আশা করছিল।কিন্তু এইটা মনে রাখা জরুরী ছিল যে, তাকে দলের অন্তভুক্তির কারণ ছিল, তার টেকনিক্যাল এবিলিটি। সে মিড থেকে খেলার টেম্পো গড়ে তুলে তার থেকে আপনি বছরে ২-৩ গোলের বেশি আশা করবেন না বরং তার খেলা দেখবেন ফুটবলপ্রেমী হিসেবে । He is not an engine, He is a Magician.
তার খেলার ধরণ সম্পর্কে জিদান একবার বলেছিল,
সে সব কিছু করতে পারে যা একটা সেন্ট্রাল মিড করে থাকে বরং সে আরো যা অফার করে তা একজন সেন্ট্রাল মিড থেকে কোন কোচই আশা করে না, তা হল পেন্টেট্রাশন। মদ্রিচের হাতে এমন পাস আছে যা ডিপে বসে থাকা প্রতিপক্ষকেও ওপেন করে ফেলে।
আর তাই তো ৯৪ মিনিটে শেষ কর্নার শট নেওয়ার জন্য কার্লো ওই দিন মদ্রিচের উপরই নির্ভর করেছিল । আমরা শুধু রামোসের গোল দেখেই বুনো উল্লাসে মেতেছিলাম কিন্তু এত সুন্দর পিন পয়েন্টে পাসের কারিগরেরও কিছু ক্রেডিট পাওনা আছে এইখানে।