মেনোত্তি দ্যা গডফাদার অফ ফুটবল
ফুটবল বিশ্বে খুব কম কোচ আছে যারা নিজেদের স্টাইলের জন্য সুপরিচিত। মেনোত্তি তাদের একজন ।মধ্য ফুটবলের সেক্সি থিংকারদের একজন। ক্রুইফদের নিয়ে যে আধুনিক ফুটবল এখন সংজ্ঞায়িত সে ক্রুইফদের বধের অস্ত্র ছিল এই মেনোত্তির কাছে। যার দর্শন মেনে এখনো কোচরা পজেশনাল ফুটবলে বিপরীতে অস্ত্র খুঁজে পাই।
১৯৭০ সাল।বছর খানেক আগে মেরে ফেলা হয়েছে বিপ্লবী “চে গুয়েবারা” কে। শাসনে তখন ডিক্টেটর ভিদেলা। আর্জেন্টিনা তাদের ইতিহাসে ক্রান্তিকাল পালন করছে।। ধনী আর গরীবের মধ্যে পার্থক্য দিন দিন বাড়ছে। সরকারের আনুগত্য মেনে নাও না হয় ধবংস হও। আর তখন তাদের ত্রানকর্তা হিসেবে আবর্তিত হোন এই মেনোত্তি। কিভাবে সেইটা আমরা পরবর্তীতে দেখতে পারব।
১৯৬৯ সালে খেলোয়াড় হিসেবে অবসর যখন নিচ্ছিল ফুটবল বিশ্বে তখনো তার নামটা সুপরিচিত নয়। পরবর্তীতে মেক্সিকো কোচ মিগুয়েলের সাথে বন্ধুত্বস্থাপন করে মেনোত্তি যায় ‘৭০ বিশ্বকাপ দেখতে। সেখানে তার আরেক বন্ধু পেলের ব্রাজিলের খেলা তাকে মনোমুগ্ধ করে এবং প্রথমবারের মত সিদ্ধান্ত নে সে কোচ হবে। আর তাই তার সিস্টেমে ও পাওয়া যায় ‘৭০ বিশ্বকাপের ব্রাজিলের ছাপ।
মেনোত্তি ‘৭৩ এ হুরাকেনের হয়ে প্রথমবারের মত জিতে নেয় মেট্রোপলিটানো(আর্জেন্টিনা ঘরোয়া) শিরোপা। তার দল এমন ভাবে খেলতে শুরু করে যে বিপরীত দলের সমর্থকরা পর্যন্ত স্ট্যান্ডিং অবিয়েশন দিতে বাধ্য হয়।
‘৭৮ এ যখন তার দল বিশ্বকাপে আসে তার প্রথম প্রেশার ছিল ওই সময়ে ম্যারাডোনাকে অন্তুর্ভুক্তি নিয়ে। দেশের সবাই যখন চাচ্ছিল ১৭ বছরের ম্যারাডোনাকে দলে নিতে। সেখানে মেনোত্তি তার সিদ্ধান্তে অটট থাকেন। বিশ্বকাপের আগে মেনোত্তি তার দলকে ১ মাসের মত ল্যাবেটরীতে আটকিয়ে রাখে। এই ১ মাস তাদের কাজ ছিল সুনির্দিষ্ট। কারো সাথে কন্টাক্ট করা যাবে না , শুধু প্র্যাকটিস, প্র্যাকটিস আর প্র্যাকটিস। তাদের শারীরিক উন্নতি জন্য প্রতিবেলা ভিটামিন খাওয়ানো হত। মোট কথা, প্লেয়ারদের উপর এক রকম মিলিটারী শাসন ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছিল মেলোত্তি। পরবর্তীতে এইটার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সে বলেছিল, আমি চাই আমরা প্লেয়াররা ফিজিক্যালি ফিট থাকুক। হাতে নাতে প্রথম ম্যাচেই সে তার সুফল পেয়েছিল। হাঙ্গেরির ফিজিক্যাল খেলার বিপরীতে যখন তার দল ২-১ গোলে জিতে যায়। মেনোত্তির খেলার ধরন ছিল,, “Feel the ball, pass it, dribble it.” মেলোত্তি ম্যাচ জিততে চায়, জিততে চায় সুন্দরতম খেলা উপহার দিয়ে।
“You can lose a game, but what you cannot lose is the dignity earned by playing good football.”
তবে বাস্তবতা হল তার কথার সাথে তার খেলার ধরণে তেমন মিল নেই। তার অধীনে আর্জেন্টিনা সুন্দরতম ফুটবল উপহার দিলেও এইটা ছিল মূলত প্রাগমেটিক এপ্রোচ। যেইটা এইবার মাদ্রিদে জিদান করে দেখিয়েছে।যেখানে আপনার ডিফেন্স করলে সেইটা ও একটা আর্ট বলে পরিচিত হয়।
মেলোত্তি ‘৭৮ বিশ্বকাপে ফরমেশন ছিল ডাচদেরই করা ৪-৩-৩। ফরমেশন একই রকম থাকলে খেলার ধরন কিংবা স্টাইল ছিল সম্পূর্ণ রকম ভিন্ন। মেলোত্তি ৪-৩-৩ সিস্টেম মুলত ব্রাজিলের ৪-২-৪ থেকে মডিফাই করা। যেখানে গ্যালাগো ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার (ডেস্ট্রোয়ার)। অন্যদিকে আরডিয়াস হচ্ছে ক্রিয়েটিভ বক্স টু বক্স মিডফিল্ডার। মেলোত্তির সিস্টেমে এই বক্স টু বক্স মিডফিল্ডারের ভূমিকা অসাধারণ। এইখানে আরডিয়াস কিন্তু ব্রাজিলের পউলির মত শুধু মাত্র ফিজিক্যাল স্ট্রং ছিল না পাশাপাশি তাকে অবশ্যি ক্রিয়েটিভ হতে হবে। হার্ডওয়ার্কিং মিড বলতে যা বুঝায়, তাই ছিল এই আরডিয়াস। পজেশন বল উইন করা, খেলা বিল্ড করা ফ্রম ব্যাক। বাকিদের রিকভারি রান দেওয়া থেকে শুরু করে এমন কোন কাজ নেই যা তাকে দিয়ে করানো হত না। আর তাদের উপরে এটাকিং মিডে খেলত মারিও ক্যাম্পেস যে কিনা পজিশন সুইচ করতে পারত সেন্টার ফরওয়ার্ড লুকের সাথে। মেলোত্তির সিস্টেমের সব থেকে বড় পরিবর্তন আসে আসলে দুই উইংগার ক্ষেত্রে। প্রথমবারের মত ফুটবল বিশ্ব দেখে, উইংগাররা কাট ইনসাইট করে বক্সে ঢুকছে। আর এদের থেকে ইন্সপায়ার হয়ে মুলত উঠে আসে আজকে রোনালদো,মেসি, রোবেনদের মত কাট ইনসাইড উইংগাররা। উইংগাররা যখন কাট ইনসাইট করে ঢুকবে তখন ফুলব্যাকদের কাজ হল তাদের ওভারল্যাপ করে আক্রমণ ধরে রাখা । আর এই পুরো কাজটা দেখভালের দায়িত্বে থাকত মুলত মিডে আরডিয়াস আর গ্যালাগো জুটি। আর তার এই সিস্টেম থেকে পরবর্তীতে মরিনহো ৪-২-৩-১ সিস্টেম ডেভেলাপ করে।
খেলা সংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের দেশের একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, “খেলার সাথে রাজনীতি মিশাবেন না।” বাস্তবতা হচ্ছে, খেলার সাথে সব সময় রাজনীতি ছিল। খেলার মাধ্যমে খেলোয়াড়রা তাদের জাতি, সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। আর মেনোত্তি তার খেলার সিস্টেমে সরাসরি তার রাজনীতির দর্শনটাও তুলে এনেছিল। মেনোত্তির মতে, ফুটবলে দুইটা ধারা একটা হল রাইট উইং ফুটবল অন্যটা হল লেফট উইং ফুটবল। সে সময়, আর্জেন্টিনায় ডিটেক্টরশিপ চলছিল। সোশিওলিস্ট ধারা হওয়ায় মেনোত্তি বেছে নে “লেফট উইং ফুটবল”কে ।মেনোত্তির কাছে রাইট উইং ফুটবলের ব্যাখ্যা ছিল এমন,” রাইট উইং ফুটবল আমাদের শিখিয়েছে কিভাবে স্ট্রাগল করতে হয়। রাইট উইং ফুটবল আমাদের স্যাক্রিফাইস করতে শিখায়। আমাদের শিখায় যেভাবে হোক না কেন দিন শেষে আমরা জয়ী হব।” অন্যদিকে লেফট উইং ফুটবল বলতে আমরা বুঝি আলট্রা এটাকিং ফুটবল যেখানে সুন্দর ফুটবলের জয় হবে। আর আর্জেন্টিনার এই রাইট উইং পন্থী ধারার কোচ ছিলেন তাদের ‘৮৬ বিশ্বকাপজয়ী বিলর্দো।
মেনোত্তি যখন কোচ হয় তখন আর্জেন্টিনায় চলছিল রাইট উইং ফুটবলের যুগ।তা এই রাইট উইং ফুটবল কেমন ছিল? মিলি ক্রাবার The story has been told এ এর নদিস পাওয়া যায়,
“ওই সময় আর্জেন্টাইনরা ফুটবল মাঠে খালি দৌড়াত। না জিতা পর্যন্ত তারা দৌড়াত যেমনটা মিলিটারীরা করে থাকে। তাদের খেলার ধরণ দেখলে যে কেউ বুঝতে পারত এরা ডিটেক্টরশিপে অধীনে থাকা কোন দল। যাদের কাছে ফুটবল হল জয়ের খেলা। “
এই জিনিসটাই পছন্দ ছিল না মেনোত্তির। মেনোত্তির কাছে ফুটবল ছিল আনন্দের খেলা। মেনোত্তি ফুটবলের মধ্যে দিয়ে কবিতা লিখতে পছন্দ করত। মেনোত্তি রোমান্টসিজম পছন্দ করত। শর্ট পাস, কুইক ওয়ান টু ওয়ান ফুলব্যাক ওভারল্যাপিং যা আসলে বর্তমান আর্জেন্টিনার ভক্তরা চাই সেইটাই করে দেখাত মেলোত্তির টিম। মেলোত্তির দলে কোন সুপারস্টার ছিল না। কারণ সে সুপারস্টারে বিশ্বাস করত না বরং তার সে টিমপ্লে কে গুরুত্ব দিত। তাই তার দলে সবাই একটা ইউনিট হিসেবে কাজ করত। যেখানে কেউ কারো কাজে ওভারল্যাপ করবে না। মেলোত্তির এই দল এতটাই ফ্লুয়েন্ট ছিল যে, ডাচরা পর্যন্ত অবাক হয়ে চেয়েছিল ফাইনালে যখন মুখোমুখি হয়। মেলোত্তি বলেছিল, “গোলের জন্য যদি অতিরিক্ত পাস দেওয়া লাগে তবে তাই কর।কিন্তু বল ধরে রেখ।” লুইস ভাল গল যে সারা জীবন “wet dream” এর কথা বলে গিয়েছে সেইটা মেলোত্তির এই ফুটবল টিমকে দেখেই। খুব স্বল্প সময় কোচ থেকেও তার মাধ্যমে জেগে উঠে আবার আর্জেন্টাইনদের স্বপ্ন। ডিটক্টেটর অধীনে থেকে যখন তারা মৃত্যুদিন গুনত মেনোত্তির ফুটবলের মাধ্যমেই তারা খুঁজে নিত আনন্দ।আর ইনভার্টেড উইংগার, ফুলব্যাক ওভারল্যাপিং মত আইডিয়ার জন্য ফুটবল সারাজীবন তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।
ডিক্টটরশিপ পতনের পরপর আর্জেন্টিনা ফেডারেশন মেনোত্তিকে ছেড়ে দে আর তার জায়গায় আসে বিলার্দো। বিলার্দো এসেই ফিরে যায় আর্জেন্টিনার রাইট উইং ফুটবলে। তার দর্শন ছিল খুবই সহজ সরল , “FOOTBALL IS ALL ABOUT WINNING AND NOTHING ELSE“। হ্যা আর এই জয়ের জন্য বিলার্দো যে কোন কিছু করতে রাজি। কিভাবে জয় পাচ্ছি সেইটা তার কাছে কোন মেটার করত না। জয়টাই তার কাছে বড়। সেইটা সুন্দর ফুটবল খেলে হোক কিংবা কুৎসিত ফুটবল দিয়ে।মাঠে ডিটেক্টরের ভূমিকা পালন করত ম্যারাডোনা। বাকীরা মিলিটারী শাসনের মত তার কথা মত চলত। আর এই দুইটা দর্শন আর্জেন্টিনা ফুটবলকেও পুরোপুরি দ্বিভক্ত করে ফেলেছে। আর্জেন্টিনার ভক্তরা যে সুন্দর ফুটবলের কথা বলে সেইটা মেলোত্তির রেখে যাওয়া ফুটবল কিন্তু সে ফুটবল আবার তারা খেলতে চায় ম্যারাডোনা কিংবা হালের মেসিকে কেন্দ্র করে। যেইটা অসম্ভব।কারণ সুন্দর ফুটবল কখনো আপনাকে নিশ্চিত রেজাল্ট দিবে না। আপনাকে হার মেনে নেওয়ার মানসিকতা সেখানে থাকতে হবে।ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা সুন্দর ফুটবল খেলত না সেখানে শুধু ম্যারাডোনাই সুন্দর ফুটবল খেলত বাকীরা তাকে খেলতে সাহায্য করত। মেসির এই কমান্ডিং গুণটি না থাকার কারণেই মূলত সে সাফল্য পায় না জাতীয় দলে। আর এইটার পরিস্কার ব্যাখ্যা পাওয়া গিয়েছিল মেনোত্তির একটা ইন্টারভিউতে ২০০৫ সালে
“আপনি যদি সাগরে ১০০০ মিটার দূরে থাকেন কেউ না কেউ এসে আপনাকে বাঁচাতে পারবে। কিন্তু আপনি যদি ১০০০০০ মিটার দূরে থাকেন কেউ এসে আপনাকে বাঁচাতে পারবে না। বর্তমান আর্জেন্টিনার অবস্থা ও একই। তারা জানে না তারা কি করতে চায়।”
৩২ বছর হয়ে যাওয়ার পরেও আর্জেন্টিনার ফুটবল আর না আগানোর কারনটাও এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে।