রিয়াল বনাম ফ্রাংকফ্রুট(৭-৩) ঠিক যে দিন সবাই মেনে নিয়েছিল মাদ্রিদের শ্রেষ্টত্ব

রিয়াল বনাম ফ্রাংকফ্রুট(৭-৩) ঠিক যে দিন সবাই মেনে নিয়েছিল মাদ্রিদের শ্রেষ্টত্ব

2018, Aug 20    

বলা হয়ে থাকে, মাদ্রিদ তার প্রথম ৫টা ইউরোপিয়ান কাপই জিতেছিল ফ্রাংকোর হাত ধরে। ব্যাপারটা সত্য না মিথ্যা তা নিয়ে আমাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। আমরা ট্যাকটিক্যাল জগতের মানুষ। আমরা দেখার চেষ্টা করব, আমরা ট্যাকটিক্যালি তখন কতটা সুপিয়র ছিলাম অন্যদের তুলনায়।

এর আগে টানা ৪টা ইউরোপিয়ান কাপ জিতলেও নাক উঁচু ব্রিটিশ মিডিয়ার কাছে আমরা তখনো লাকি দল যারা কিনা প্রতিবার কোন ভাবে ভাগ্যের জোরে জিতছি। হা , সময় পরিবর্তিত হয়। কিন্তু মিডিয়ার অবস্থান মাদ্রিদের বিপরীতে তেমন কোন পরিবর্তন হয় না । তাই বর্তমান সময়েও আমাদের প্রতিটি জয়কে ভাগ্যের জোর বলে দেখানো হয়। শ্রেষ্টত্ব প্রমাণের জন্য তাই মাদ্রিদকে এই ম্যাচটি জিততেই হবে। যেমনটা গতবার জিদানের সময় হয়েছিল।

জিদান সময়কালীন মাদ্রিদের সব লিজেন্ডরা কম বেশি একটা কথা বলত । জিদানের হাত ধরে মাদ্রিদ তার হারানো অতীত ফিরে পাচ্ছে। হা এই ম্যাচটির ট্যাকটিক্যাল অংশটুকু আলোচনা করলেই আমরা দেখতে পারব কেন তারা জিদানের মধ্যে মিগুয়েলের ছায়া খুঁজে পেয়েছিল।

১৯৬০ সালের এই দলটি ছিল সময়ের অন্যতম সেরা দল। প্রতিটা পজিশনেই ইতিহাসের সেরা প্লেয়ার ছিল বলেই শুধু নয়। এই দলের দেখার মত বিষয় ছিল সবাই সুপারস্টার হবার পরেও নিজেদের পারসোনাল গ্লোরীকে সাইডে রেখে একসাথে সাদা জার্সির জন্য ফাইট করা। এই দলের প্রতিটা প্লেয়ার বাকী সদস্যদের সকল পজিশন সম্পর্কে অবগত ছিল। এতটাই যে, চোখ বন্ধ করে পাস দিলেও তারা ঠিকই তাদের টিমমেইটদের খুঁজে পেত। সম্ভবত টানা একসাথে এত বছর খেলার জন্য তাদের মধ্যে বোঝাপড়াটা ওই পর্যায়ে এসে গিয়েছিল। এই টিমের প্রধান আকর্ষণ ছিল তাদের র‍্যাপিড শট পাসিং স্টাইল দ্রুততার সাথে আর ফ্লুয়েডিটি।

প্রথমে দেখি আসি ওই সময় আমাদের স্কোয়াডে কে ছিল। গোলবারের দায়িত্ব পালন করত ডমিগুয়েজ। আর তার সামনে ছিল ৩ ম্যান সিবি-, পাচিন, সান্তামারিয়া, মারকিউটোস। তাদের সামনে ছিল ক্লাব লিজেন্ড স্টাফিনো, জারা, ভিদালের ৩ ম্যান মিড। আর ফ্রন্টে জিন্টো, পুসকাস, ডেল সল, কানারিও। এই দলের মেইন স্টাইকার ছিল স্টিফানো। আর তার রোলটা ছিল বর্তমান সময়ের বেনজেমার মত। রোনালদো আসার আগ পর্যন্ত আমাদের সেরা লেফট উইংগার ছিল জিন্টো। আমাদের দুই উইংগার জিন্টো, কানারিও ছিল ঐ সময়ের সেরা দুইটা বুলেট। বর্তমান সময়ে বেল এবং রোনালদো যে কাজ করত ঠিক তেমন। তাদের পেস এত বেশি ছিল যে ডিফেন্ডাররা তাদের মার্ক করতেই ভয় পেত। কখন না এত দ্রুত দৌড়াতে গিয়ে এংকেল ব্রেক হয়ে যায়। তো আমাদের ফরমেশন ছিল ৩-৩-৪ অন্যদিকে ফ্র্যাংকফ্রুটের ৩-২-২-৩

সে সময় ট্যাকটিক্যাল পার্টটা এতটা গুরুত্বপূর্ন ছিল না। সবাই মোটামুটি বেসিক ট্যাকটিস ফলো করত। আর মাদ্রিদের জন্য সে বেসিক ট্যাকটিস কি ছিল? মিগুয়েল দলের সবাইকে বল পায়ে ভাল হতে হবে। মিগুয়েলের দলে লং বল এক রকম নিষিদ্ধ ছিল। তবে হ্যা ট্রানজিশনের সময় যদি দরকার পরে তখন ব্যাপারটা এলাও করা হত।তবে মুল খেলা হবে শট পাসে। পজেশন ইজ দ্যা কী টু উইন দ্যা ম্যাচ- এইটাই ছিল মিগুয়েলের দর্শন। হা পজেশন। যারা ভাবে মাদ্রিদ কাউন্টার এটাকিং দল । এই লেখা পড়ার পর তাদের ভুল আশা করি ভাঙ্গবে। আমাদের দলে সবাই ছিল সে সময় থেকেই স্পেস নিয়ে সচেতন। পুসকাস ছিল গ্রেট হাংরে পজেশনাল সিস্টেমের সব থেকে কী প্লেয়ার । পাশাপাশি আপনার মিডে আছে ডি স্টিফানোর মত স্টামিনা যে কোন সময় চাইলে এনার্জী পুশ করতে পারে। মিথ আছে, ডি স্টিফানো নাকি কখনো টায়ার্ড হত না । আর মূলত সে ছিল একজন স্টাইকার। কিন্তু খেলতে পারত সিবিতেও কারণ ওই যে তার অমানসিক স্টামিনা আর ওয়ার্করেইট। খেলাটা তাই বিল্ড হত তাকে কেন্দ্র করে। পাশপাশি দুই উইং এ পেস আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছিল আপনি বল পজেশ করতে পারলেই গোল করতে পারবেন। অন্যদিকে ফ্রাংকফ্রুটের ডিফেন্স ছিল ম্যান মার্কিং নির্ভর (আসলে তখনো জোনাল মার্কিং এর আইডিয়া ফুটবলে আসেনি।) ম্যান টুম্যান মার্ক করেছিল ফ্রাংকফ্রুট। সমস্যা হল স্টিফানোর মার্ক নিয়ে। স্টিফানো সব সময় শুরু করত ম্যাচ ফরওয়ার্ড হিসেবে আর কিছুক্ষন পর দেখা যেত সে ডিফেন্স চলে গিয়েছে। এবং এইটা শুধু এক বার দুইবার না। পুরো ম্যাচেই সে এই কাজটা করত। অনেকটা ইস্কোর ফ্রী রোলের মত। ম্যাচের এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে ফ্যাংফ্রুট তাকে মার্ক করাই বাদ দিয়ে দিল। কারণ ডি স্টিফানোকে ফলো করতে সিবি উঠে আসলে সে ফেলে আসা স্পেস ব্যবহার করত বাকী দুই ফরওয়ার্ড পুসকাস, ডেল সল। তার উপর উইং ছিল পেস। যারা চাইলে যে কোন সময় এনার্জী পুশ করতে প্রস্তুত। বুঝুন তখন বিপররীত দলের কোচের কি অবস্থা। কোনভাবে কি কোন আইডিয়া মাথায় আসছে আপনার? আসলেই একটা দল এতটা ফার্স্ট ফুটবল খেললে এত পেস নিয়ে বিপরীত দলের অসহায় আত্মসমপর্ণ ছাড়া কিছু থাকে না।

এই বার আসি খেলাটা কিভাবে বিল্ড করত না তা নিয়ে। আগেই বলেছি, এই দলের মূল দর্শন পজেশন আর র‍্যাপিড শট পাসিং। রিয়ালের সেন্টার ব্যাকদের বল পায়ে ভাল হওয়াটা আবশ্যক আর বল প্লেয়িং সিবি হিসেবে ব্যবহার করা হত সান্তা মারিয়াকে। সে মিডে ডি স্টিফানো, জারা এবং ভিদালের মধ্যে পাসিং খুজে নিত। আর তাকে প্রেস করা হলে বল প্লে হত ওয়াইডে। তখন দুই উইংগার গিন্টো, কানারিও নিচে নেমে এসে খেলা বিল্ড করতে সাহায্য করত। সবার টার্গেট থাকত মিডে ডি স্টিফানোকে খুজে বের করা। ডি স্টিফানো খেলা অপারেট করত একদম সেন্টার থেকে। বল পেলেই এক -দুই পাসে সে বল দিয়ে দিত দুই মিড জারা অথবা ভিদালকে। আরা জারা, ভিদাল বল কই দিত? জিদানের মাদ্রিদকে মনে আছে? একদম ঠিক। উইং এ :p তারপর কি হত ? সেই চিরাচরিত ক্রস :D মাদ্রিদস্তাদের “বালের ক্রস ট্যাকটিস”।

কিন্তু উইং যদি ব্লক থাকত তাহলে কি হত? এখন সুইচ প্লে। অর্থ উইং পরিবর্তিত হবে। উইংগার বল পাস করত মিডে তারপর অন্য উইং দিয়ে আবার ক্রস চালানোর চেষ্টা করা হত। যদি দুই উইং ব্লক থাকে তাহলে আক্রমণ হবে সেন্টারে । এইবার কী হল পুসকাস । হাংরে পজেশনাল দলে সে যে রোল পালন করত এখনো সেইটা। সে তখন ড্রপ করত ফরওয়ার্ড লাইন থেকে আর পজিশন ইন্টারচেঞ্জ করত ডি স্টিফানোর সাথে। ডি স্টিফানো তখন স্টাইকার। ডি স্টিফানো, পুসকাস , ডেল সেলো নিজেদের মধ্যে ক্রমাগত পজিশন ইন্টারচেঞ্জ করে ডিফেন্স লাইন ব্যস্ত রাখত। তারা ডিফেন্স লাইন ভাঙ্গার জন্য ব্যবহার করত তাদের পজিশন সেন্স আর ওয়ান টু ওয়ান পাসিং । এই জন্য বলে রাখি, মাদ্রিদ কখনো টার্গেট ম্যান কিনবে না। মাদ্রিদ ট্রেডিশনাল নাম্বার ৯ এ ইন্টারেস্ট না। মাদ্রিদে খেলতে হলে অবশ্যি আপনার ওয়ান টু ওয়ান পাসিং, পজিশন সেন্স, ওয়ার্করেইট এইগুলাতেই গুরুত্ব দেওয়া হয়।

এই রিয়াল মাদ্রিদ ট্রানজিশন ছিল অনেক স্লো। যেহেতু পজেশন ডমিনেট করতে চাইত । তাই বল নিজেদের পায়ে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। কিন্তু এই দলই কর্নারের সময় অন্য রকম হয়ে যেত। প্রতিপক্ষ কর্ণার পেলে পুসকার এবং দেল সেলো দুইজনে সেন্টারে এসে যেত। গিন্টো, কানারিও প্রস্তুত থাকত এনার্জি পুশ করার জন্য। এই মাদ্রিদের বিপক্ষে কর্নার নেওয়াটা ছিল ভয়ংকর একটা কাজ। কারন কোন ভাবে যদি মাদ্রিদ কর্নার ইন্টারসেপ্ট করতে পারে তারা ডিরেক্ট কাউন্টার মারত। খুব দ্রুইত বল সাপ্লাই দেয়া হত উইং এ অথবা সেন্টারে আর যেহেতু পুসকাসের বল কন্ট্রোল ভাল ছিল পাশাপাশি দুই উইং এ এনার্জী তাছাড়া দেল সেলো সাথে অয়ান টু ওয়ান নিশ্চিত করছিল যে, আপনি ভুল করলেই এই দল আপনাকে ছিড়ে খেয়ে ফেলবে।

এইতো গেল সব পজিটিভ দিক। এইবার আসি কিছুটা নেগেটিভ দিকে । জিদানের মাদ্রিদের মত এই মাদ্রিদের ও সেইম সমস্যা ছিল সেইটা হল “a bit of chaos” । ডিফেন্স লাইন ভুল করে ফেলার অভ্যাস। আমরা যে ডিফেন্সে এখনো ভুল করি এইটা আমাদের ঐতিহ্য। পুরো খেলা আমাদের কন্ট্রোলে থেকে হঠাৎ ডিফেন্সে ভুল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত কিংবা গোলকিপারের সিলি মিস্টেইক। এইগুলা সবই আমাদের ঐতিহ্য। আমাদের লিজেন্ডারী দলের মধ্যেই এই সব ছিল। বর্তমানে দলে থাকবে না কেন বলেন?

এত সব পরেও আমাদের কোন কালে জিততে কষ্ট হত না। কারণ হল মাদ্রিদের নীতি ছিল এটাক, এটাক আর এটাক। মাদ্রিদ ডিফেন্স করতে জানে না। তাই ৩ টা খাওয়ার পরে ও আমরা ৭ টা দিতে সমর্থ হয়েছিলাম সেইদিন। আমাদের সাথে ওপেন প্লে করতে গেলে দলগুলো তখন দুইবার ভাবত। অবশ্যি ডিফেন্স করে ও কোন লাভ ছিল না। আমরা এতটা সুপিরিয়র ছিলাম ওই সময় ৫ ম্যাচে ২৮ গোল বা এর কাছাকাছি দেওয়ার রেকর্ড ছিল। ম্যাচ প্রতি গড়ে ৫টা। বুঝেন অবস্থাটা :3

সেদিন মাঠে বসে খেলা দেখেছিলেন স্যার আলেক্স ফার্গুসান। তখন উনার বয়স ১৮ বছর। তার স্মৃতিচারনে তার প্রমান পাওয়া যায়, “এত ফ্লুয়েড এত এটাক আমি জীবনেও কখনো দেখিনি।” ক্লাব ফুটবলে এত স্টার, এত ব্যালান্সড অতীত কিংবা বর্তমান কোন দলই দেখাতে পারেনি। বাকী দলগুলোতে দেখা যেত স্টার প্লেয়ারদের মধ্যে মনোমালিন্য হচ্ছে অথবা স্টার প্লেয়ার থাকলেও দলে ব্যালান্স আসছে না। যেইটা ২০০০ সালের পর আমাদের নিজেদের সাথেই হয়েছে। কিন্তু মাদ্রিদে ছিল তা ভিন্ন। মাদ্রিদে যে স্টারই আসত না কেন সে ব্যাজের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত ছিল।

আমরা অনেকেই নিজেদের প্লেয়ারদের নিয়ে অনেক কটু কথা বলে থাকি। মনে রাখতে হবে, এরা আমাদেরই প্লেয়ার। ফর্ম খারাপ যেতে পারে । হয়ত ট্যাকটিস, কিংবা কোচ তাকে নিয়ে অন্যভাবে চিন্তা করছে কিন্তু সে যতক্ষন মাদ্রিদ জার্সিতে আছে ততক্ষণ সে এই ইতিহাসের অংশ। সেই ইতিহাস যারা ৪টা ইউরোপিয়ান কাপ জিতার পরেও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল এবং নিজেদের শ্রেষ্টত্বের প্রমাণ দিয়েছিল ৭ গোল দিয়ে। এখনো মনে হয়, উচলে এইটাই কোন ফাইনালে সব থেকে বেশি গোলের রেকর্ড। দুইবার ভাববেন এদের নিয়ে কথা বলতে। কারণ এরাই আমাদের সাদা জার্সির মর্যাদা রক্ষার জন্য এই লড়াই করে মাঠে । বেচে থাকুক ডি স্টিফানো , সান্তামারিয়া, পুসকাস, জারা, ভিদাল, গিন্টোরা চিরকাল আমাদের হৃদয়ে।