ফুটবলের বেসিক থিউরী

ফুটবলের বেসিক থিউরী

2018, Aug 28    

আমাদের ফুটবল নিয়ে আগ্রহ। আর সহজাত দৃষ্টি নিয়ে যখন দেখি তখন মনে হয় ফুটবল গোলের খেলা। গোল মিস করলে মনে হয় এই প্লেয়ারটা বাজে। ব্যাক পাস দিলে মনে হয় এই বেচারা মনে হয় খেলতেই পারে না। কথা হল, আসলেই কি আপনি মনে করেন, ফুটবল এতটাই সহজ? আপনি যে গোল করেন সেই গোলের স্পেস কিভাবে আসে সেইটা কি কখনো চিন্তা করেছেন? আর এই সব নিয়েই আমরা আজকে ফুটবলের সব থেকে বেসিক জিনিস গুলো নিয়ে আলোচনা করব।

গোল হচ্ছে রেজাল্ট। কিন্তু ফুটবল নিজে গোলের খেলা নয়। ফুটবলের ট্যাকটিক্যাল থিউরী পুরোটাই হল স্পেস থিউরী। শুধু ফুটবল না, যে কোন পজেশনাল বেসড গেইমে মেইন জিনিস হল স্পেস। আপনাকে জানতে হবে স্পেস কোথাইয়। একটা ভাল প্লেয়ার সেই যে কিনা স্পেস খুজে পায়। একটা ভাল কোচ সেই যে কিনা ক্রমাগত স্পেস ক্রিয়েট এবং এক্সপ্লয়েট করতে পারে। তো ফুটবলে এই স্পেস কই প্রকার? ৩ ধরনের স্পেস আছে ফুটবলে

  • ভার্টিকেল স্পেস
  • হরিজন্টাল স্পেস
  • এরিয়াল স্পেস

একটা টিমের ট্যাকটিক্যাল প্ল্যান নির্ভর করে এই ৩টা স্পেসকে সে কিভাবে ব্যবহার করছে । আর ট্যাকটিক্যাল এনালাইজ করা হয় ওই দলের প্লেয়িং সিস্টেম এবং প্লেয়িং স্টাইলের উপর। দেখুন, এইখানে সিস্টেম এবং স্টাইল সম্পূর্ন ভিন্ন জিনিস। আপনি স্টাইলকে স্টাইল আর সিস্টেমকে সিস্টেম বলতে হবে। একটার জায়গায় অন্যটা বললে দুইটা ভিন্ন অর্থ বহন করবে। একটা দল ট্যাকটিস বানায় তাদের প্লেয়িং সিস্টেমের উপর মানে হল এটাকিং এর সময় আমাদের দলের শেইপ কেমন হবে। আবার ডিফেন্সিভ পিরিয়ডে শেইপ কেমন হবে। ট্রানজিশনের সময় কি করবে। এই সব স্ট্যাটেজিক প্ল্যানই হল প্লেয়িং সিস্টেম। আর এই সিস্টেম থেকে আসে প্লেয়িং স্টাইল। যেমনঃ আমরা কি সিংগেল প্লেয়ার ওরিয়েন্টেড খেলব নাকি টিম বেসড। তার মানে দেখা যাচ্ছে, প্লেয়িং সিস্টেম ডিফারেন্ট হলে সেইটা প্রভাব পড়ে স্টাইলে। কিন্তু স্টাইল চেঞ্জ করা যায় যে কোন সময়। নানা রকম স্টাইলে আপনি একটা খেলা খেলাতে পারেন । এইটা কখনো সিস্টেমকে পরিবর্তন করতে পারবে না।

এইবার আসি আরো কোর কনসেপ্টে। একটা ট্যাকটিক্যাল সিস্টেম যখন দাঁড় করানো হয় তখন মূল লক্ষ্য থাকে কি? কিভাবে প্রতিপক্ষের থেকে বেশি গোল দেওয়া যায়। ভুড়ি ভুড়ি গোল দেওয়া কারো লক্ষ্য থাকে না। সিস্টেমের কারণে ভুড়ি ভুড়ি গোল হয়। প্রাইমেরী লক্ষ্য সব কোচের একই। যত বেশি সম্ভব গোল দেওয়া এবং যত কম সংখ্যক গোল খাওয়া। যে সিস্টেমই দাড় করানো হোক না কেন সেই সিস্টেমই এই ২টা জিনিসের ১ টা কিংবা দুইটা জিনিসই একসাথে এচিভ করতে চায়।

ফুটবলে সব থেকে গুরুত্বপুর্ণ সেকেন্ড থিউরী হল পজেশন। পজেশনকে সহজ বাংলায় ব্যাখ্যা করতে গেলে বলা যায়, বলের উপর কন্ট্রোল। যদিও এইটা নিয়ে মতভেদ আছে। সেদিকে গেলাম না। এইটা নিয়ে আমার অন্য লেখাতে বিস্তারিত পাবেন। মোট কথা, পজেশন বলতে গেইমের কন্ট্রোল আপনার হাতে। আপনি নির্ধারন করবেন আপনার ভবিষ্যত কি। বল কোন প্লেয়ারের পায়ে থাকা মানে হল অন দ্যা বল পজেশনে আছে সে। আর বাকীদের বিবেচনা করা হয় অফ দ্যা বল এর প্লেয়ার বলে।

প্রতিটা দলই পজেহসন উইন করতে চায় যে কাউন্টার এটাক দিতে চায় তাকেও পজেশন উইন করতে হয়। পজেশন ছাড়া কেউ কখনো কাউন্টার দিতে পারে না। পজেশন মানেই হল বলের উপর কন্ট্রোল। অথবা স্পেসের উপর কন্ট্রোল। এখন আপনি আমাকে বলুন, বল এবং স্পেস নিয়ন্ত্রন না নিয়ে আপনি কিভাবে কাউন্টার দিবেন? বল ছাড়া কি গোল দেওয়া সম্ভব? উত্তর হল না। তাহলে যে মানুষ বলে আমি কাউন্টার পছন্দ করি, আমি পজেশনাল পছন্দ করি এর অর্থ কি? ফুটবলের থিউরীটিক্যাল ভাষায় এর অর্থ হল phase of play. এইটার উপর নির্ভর করে আপনার ট্যাকটিক্যাল অরগানাইজেশন কেমন হবে। যখন কোন দল এটাকিং অবস্থায় থাকে সে দলের ফেইজকে কে বলা হয় এটাকিং ফেইজ। ঠিক তেমনি বিপরীত দল ডিফেন্সিভ ফেইজ এ চলে যায়। আপনি কাউন্টার পছন্দ করেন তারমানে আপনি ডিফেন্সিভ ফেইজে বেশি থাকতে পছন্দ করেন।

আগেই বলেছি ফুটবলে সব থেকে গুরুত্বপুর্ন বিষয় হল স্পেস। আপনি কিভাবে স্পেস ব্যবহার করছেন সেইটার উপরে আপনার ট্যাকটিসের সফলতা নির্ভর করে। আর এইটার থিউরীক্যাল নাম হল ট্যাকটিক্যাল ডায়ানামিকস। এইটার আবার ৩টা পার্ট।

  • ট্যাকটিক্যাল শেইপ।
  • প্লেয়ার মুভমেন্ট।
  • বল মুভমেন্ট।

এই ৩টায় আপনাকে স্পেস ব্যবহার করা শিখাবে। আপনার দলের নাম্বার ৯ যদি মুভ না করে তাহলে উইংগার কাট ইন করতে পারবে না। আর সেক্ষেত্রে উইংগারের স্কোরিং এবিলিটি কমে যাবে। এইটা হল প্লেয়ার মুভমেন্ট। আবার আপনার দলের মেইন স্কোরার যেহেতু উইংগার পজিশনে খেলে আপনাকে যেভাবেই হোক এমন একটা ট্যাকটিক্যাল সলিউশন দাঁড় করাতে হবে যাতে উইংগার স্টাইকিং প্রান্তে আসলেও শেইপের যাতে কোনভাবে বাধাগ্রস্থ না হয়। এর পর হল বল মুভমেন্ট। বল কোথায় যাচ্ছে কোন পজিশনে আছে সেইতার উপর নির্ভর করে স্পেস পরিবর্তন হতে পারে। মোট কথা স্পেস পেতে গেলে এই ৩টা জিনিস সম্পর্কে প্লেয়ার এবং কোচ দুইজনেরই ভাল ধারনা থাকতে হবে তাহলেই সাফল্য আসবে।

এইবার বলি প্লেয়ার পজিশন কি। এক কথা আপাতত উত্তর দিয়ে যায়, অন্যান্য টিমমেইটদের সাপেক্ষে একতা রেফারেন্স পয়েন্ট। আধুনিক ফুটবলে সব কোচই মাল্টি পজিশনে খেলতে পারে এমন প্লেয়ারই পছন্দ করে। তাই ভার্সেটাইল হওয়াটা এখন খুব গুরুত্বপুর্ণ।

এখন বলব প্লেয়িং মেথড নিয়ে। প্লেয়িং মেথড হল প্লেয়িং সিস্টেমের সব থেকে গুরুত্বপূর্ন অংশ। আবার বলছি সিস্টেম কিন্তু স্টাইল নয়। তো এই মেথড নির্ভর করে প্লেয়ারদের পারসোনালিটি, ট্যাকটিক্যাল ব্যালান্স, প্লেয়ারদের সুইটাবিলিটির উপর।

ট্যাকটিক্যাল ব্যালান্স হল নির্ভর করে আবার ট্যাকটিক্যাল রিস্ক লেভেলের উপর।(এত তথ্য আমি নিজেই হারাই যাচ্ছি)।প্রশ্ন জাগতে পারে, ট্যাকটিক্যাল রিস্ক লেভেল কি ?

আপনি যত ভালই ট্যাকটেসিয়ান হোন না কেন সব ট্যাকটিসই রিস্ক লেভেল থাকে। আপনি যদি মনে করেন আমার ট্যাকটিসই সেরা সব ছিড়ে ফুড়ে খেয়ে ফেলব এই ট্যাকটিস দিয়ে, সেইটা আপনার অহংবোধ ছাড়া কিছুই না। থিউরীটিক্যালি প্রতিটা ট্যাকটিসের রিস্ক ফ্যাক্টর আছে। আর এইটার বেস করে দুইতা রিস্ক আছে একটা হল ডিফেন্সিভ রিস্ক দ্বিতীয় হল, এটাকিং রিস্ক। আপনি এটাক করলে কাউন্টার খাবেন আবার আপনি ডিফেন্স করলে স্পেস হারাবেন তাতে প্রতিপক্ষের গোল দেওয়ার সম্ভবনা বাড়বে। আবার আপনি যদি রিস্ক নিয়েই থাকেন সেইটা আপনার জন্য প্লাস পয়েন্ট হতে পারে। ট্যাকটিক্যাল রিস্ক শাপে বরের মত। লেগে গেলে সবাই বলবে লাকী। না লাগলে বলবে বাজে কোচ। উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে গত উচলে পিএসজি মাদ্রিদের প্রথম লেগ। মাদ্রিদ পিএসজির লেফট সাইডে ফোর্স্ফুল ম্যান পুশ করছিল ম্যাচ জিতার জন্য। এইটা হিউজ একটা গ্যাম্বল ছিল। কারণ এতে মাদ্রিদ মিড ছেড়ে দিয়েছিল এবং উইক লিংকে নিজেদের সব শক্তি পুশ করেছিল। যদি হেরে যেত সবাই বাজে মন্তব্য করত। জিতে যাওয়ার পর সবাই বাহবা দিচ্ছে। আবার ঠিক উলটো অনুভূতি পিএসজির শিবিরে। ট্যাক্টিক্যাল রিস্ক না নিয়ে খেলতে চেয়েছিল আর এতেই তারা হেরে গেল। এইজন্য এইটা মনে রাখা জরুরী কখন রিস্ক নিবেন আর কখন না।

আবার ট্যাকটিক্যাল ব্যালান্সে ফিরে আসি । ট্যাকটিক্যাল ব্যালান্স তখনি হবে যখন আপনাকে ট্যাকটিক্যাল রিস্ক কম নিতে হবে। পাশপাশি আপনার এটাকিং রিস্ক এবং ডিফেন্সিভ রিস্ক দুইটার মধ্যে সমতা বিরাজ করবে। থিউরীটিক্যালি সমতা বিরাজ করা সম্ভব হলেও বাস্তবিক অর্থে সেইটা সম্ভব নয়। যে কোন একটা বেশি থাকেই। এর কারণ হল ওই যে প্লেয়ারদের পারসোনালিটি। কোন প্লেয়ার উগ্র মেজাজের হলে তার ফাউল করার প্রবণতা বেশি। ট্যাকটিস বানানোর সময় আপনাকে মাথায় রাখতে হবে এইটি। তাকে গাইডলাইন দিতে হবে এটলিস্ট কোন জায়গায় ফাউল করা উচিত না। আর প্লেয়ারদের পারসোনালিটি আমাদের নিজেদের পারসোনালিটি দুইটা একই। স্বভাবগত পরিবেশ গড়ে উঠে। এইখানে কোচের বেশি কিছু করার নেই। কিন্তু ট্যাকটিক্যাল পার্টে, কোচের অবশ্যি এই সব মাথায় রাখতে হবে।

এরপর হল প্লেয়ার সুইটিবিলিটি। স্বভাবগত ন্যাচারের জন্য কোন পজিশনে খেলালে তার থেকে বেশি আউটপুট পাওয়া যাবে আবার সিস্টেমের সাথে আদৌ তার যায় কিনা। স্টাইল নয় কিন্তু। এখন দেখা গেল, আপনার দলে ১০ জন প্লেয়ার বল পায়ে ভাল কিন্তু ১ জন পরে গিয়েছে যে কিনা বল পায়ে ভাল না। এখন কথা হল, আপনি কি তাকে ছাটাই করে ১১ জনই বল পায়ে ভাল এমন প্লেয়ার নিবেন? নাকি তার অন্যান্য বৈশিষ্ট্য দিয়ে একটা ট্যাকটিক্যাল সলিউশন দাঁড় করাবেন? যেইটা করুন না কেন দুইটাতেই কিন্তু রিস্ক ফ্যাক্টর আছে। আপনার কাজ হচ্ছে, রিস্কটা মিনিমাইজ করা। একটা প্লেয়ারকে ওই সিস্টেমের প্লেয়ার তখনি বলা যায় যখন এইতার সাথে তার পারসোনালিটি কনফ্লিক্ট করে না পাশপাশি তার রোলটার জন্য বাকী ১০ জনও ফ্লুয়েন্ট খেলতে পারে।

এইহল ফুটবলের একদম বেসিক লো লেভেল থিউরী । এর পর আছে সিস্টেম ফ্লুয়েডিটি চেক যেইটা দিয়ে আপনি পরিমাপ করবেন আপনার সিস্টেম আসলে কতটুকু কার্যকর হবে। আরো আছে, পজিশনাল রেস্পন্সিবিলিটি, কোম্পনেন্ট স্টাইল, কোর স্টাইল সহ আরো অনেক অনেক কিছু। যা এক পোস্টে তো নয় ৩-৪ পোস্টে ও লিখা সম্ভব কিনা সন্দেহ আছে। মজার ব্যাপার হল, ফুটবলের কোর জিনিস হল এইগুলাই। গোল করা নিয়ে মাথা ঘামায় শুধুমাত্র ফুটবল ফ্যানরা আর কোচরা মাথা ঘামায় সিস্টেমে কিভাবে ফ্লুয়েডিটি আনা যায়। প্লেয়াররা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ওই সিস্টেমকে একটিভেইট করতে। মাথায় রাখা জরুরী, যে কোন ফ্লুয়েড সিস্টেমে ভুরি ভুরি গোল করা সম্ভব সেইটা কাউন্টার বেসড হোক কিংবা পজেশনাল বেসড।