ট্যাক্টিক্যাল এনালাইসিসঃ ক্যাসেমিরো বনাম বুসকেটস
সন্দেহ নেই বর্তমান সময়ের সেরা দুই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার নিয়ে আমরা কথা বলব। তবে বুসকেটসের রঙ্গিনময় ক্যারিয়ারের সাথে তুলনা করলে ক্যাসেকে অনেক দূর যেতে হবে এখনো। কিন্তু অনেকেই বুসকেটসের সাথে তুলনা করতে গিয়ে ক্যাসেকে অনেক ছোট করে ফেলেন। অনেকে এইটাও বিশ্বাস করেন, বুসকেটস সব দলেই জায়গা পাবেন কিন্ত ক্যাসের বেলায় সেইটা সম্ভব না। তাই এই লেখাতে চেষ্টা করব এই সব অসংগতি তুলে ধরতে।
ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার বলতে আমরা বুঝি, যে কিনা ডিফেন্সিভ কভার দিবে তার ব্যাক লাইনকে। তাদের মূল কাজ হল যেভাবেই হোক প্রতিপক্ষের আক্রমণ আটকানো সেইটা প্রতিপক্ষের ডিফেন্সিভ থার্ডে গিয়ে হোক কিংবা নিজ অর্ধে ট্যাকনিক্যাল ফাউল। এখন এই ডিফেন্সিভ রোলে দুইজনের ভুমিকা কেমন সেইতা জানতে হলে আমাদের বুঝতে হবে তাদের নিজ নিজ ক্লাবের খেলার ধরণ।
প্রথমে আসি বুসকেটসকে নিয়ে।অবসরের পর তাকে ওয়ান অফ দ্যা বেস্ট ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার বলা হবে। কিন্তু বেস্ট মিডফিল্ডার হলে কি সব সিস্টেমে যায় আসলে? চলুন দেখে আসি। পেপের বার্সার মূল লক্ষ্য ছিল পজেশনাল ফুটবল। আর পজেশনাল ফুটবল খেলতে হলে আপনাকে ধারনা থাকতে হবে স্পেস আর সময় নিয়ে। বার্সার একাডেমীতে বড় হওয়া বুসকেটসের প্রধান অস্ত্রই ছিল তার এই বুদ্ধিমত্তা। বুসকেটসের বড় গুণ হল তার গেইম রিডিং এবিলিটি। প্রতিপক্ষ কোন প্রান্তে আঘাত হানতে পারে সেইটা সে মোটামুটি কম্বিনেশন দেখলে বুঝতে পারত। এখন, ব্যাপারটা নিয়ে একটু চিন্তা করা যাক, আপনি যখন পজেশনাল ফুটবল খেলবেন। তার মানে সবারই লক্ষ্য হল, ফ্রী স্পেস খুঁজে নেওয়া। আপনি নিজেকে ফ্রী স্পেসে রাখবেন তাহলে আপনার টিমমেইট সহজে আপনাকে পাস দিতে পারবে। এই দিকে বুসকেটসের যে সুবিধে হল, যেহেতু সে তার বাকী টিমমেইটদের পজিশন এবং বিপরীত দলের প্লেয়ারদের পজিশন সম্পর্কে অবগত সে মোটামুটি আন্দাজ করতে পারে ফ্রী স্পেসটা কোন জায়গায় আর প্রতিপক্ষ কোন স্পেস এক্সপ্লোয়েট করতে পারে। অন্যান্য ডিফেন্ডারদের সাথে তার এই জায়গায় মূল পার্থক্য হল, যেমন ক্যাসে হল যেই কাজটি করত প্রথমেই চার্জ করত প্লেয়ারটিকে। বুসে এই রকম না। বুসে বেস্ট পসিবল কম্বিনেশন খুঁজে। তাই সে আগে দেখবে এনাফ বার্সা প্লেয়ার ওই পজিশনে আছে কিনা। যদি থাকে, তাহলে সে পাসিং লাইন অফ করবে যাতে সহজে আউটনাম্বার করা যায় প্লেয়ারটিকে। আর যদি না থাকে তখন সে ট্যাকল করার সিদ্ধান্ত নে।আর এই সিদ্ধান্তটাই সে নিয়ে থাকে মিলি সেকেন্ডের ভিতর। খুব সহজে তার আই কিউ উপর ভিত্তি করে সে সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় থাকতে পারে।
তাছাড়া, বার্সা একাডেমী থেকে উঠে আসায় তার আরেকটি বিশেষ গুণ হল প্রেস রেসিস্টেন্স। খুব কম মিডফিল্ডারই আছে যাদেরকে প্রেস করলে উলটো আপনার ক্ষতি। বুসকেটস অনেকটা এই রকম। হাই প্রেসও সে ঠান্ডা মাথায় বল ঠিকভাবে পাস করতে পারে। তার ক্যারিয়ার ৯০% পাসিং রেশিও সেই কথায় বলে। এইজন্য সহজে তাকে ডিসপোস করা যায় না মাঠে। সমকালীন মিডদের মধ্যে সম্ভবত তার রেশিই সব থেকে কম ডিসপোসড হওয়ার। বুসকেটস বার্সাতে সবসময় ডিপ লাইয়িং প্লেমেকার হিসেবে ব্যবহৃত হত। তার ক্যারিয়ারে আরেকটি বড় গুণ হল চান্স ক্রিয়েশন। ম্যাচ প্রতি সে .৭ কী পাস দে যেইটা একজন ডিফেন্সিভ মিড থেকে সাধারণত কেউ আশা করে না। সহজ কথায়, বুসকেটসের গেইম প্ল্যানটাকে বলা যায়, এনাদার সুপিরিওর পাসিং মনস্টার যে হাই প্রেসেও আপনাকে সহজে বলের যোগান দিয়ে যাবে এবং তার বুদ্ধিমত্তা দ্বারা সে বিপরীত দলের কাউন্টার আটকাবে।
এইবার আশা যাক, ক্যাসের দিকে। ক্যাসের রোলটি মাদ্রিদে খুবই পরিস্কার। সে একজন ডেস্ট্রোয়ার। তার কাজ হল ট্যাকল করা, ইন্টারসেপ্ট করা এই সব। মোদ্দা কথা হল, সে বুসকেটসের মত আকর্ষণীয় কোন ফিগার না। তবে হ্যা, সে হল দলের মূল স্ট্রিং। আপনার দলে যখন ১০ টা প্লেয়ার লড়াই করার জন্য তখন এমন কাউকে দরকার যে বেস্ট হওয়ার প্রতিদন্ধীতায় নামবে না বরং সে সাহায্য করবে বাকী ১০ জন প্লেয়ার যেন নিজেদের খেলা খেলতে পারে। ছোটবেলায় বিটিভিতে ক্যাপ্টেন প্লেনেট নামে একটি কার্টুন দেখতাম। সেখানে একটি চরিত্র ছিল মা-টি। বাকীদের অনেক সুপার পাওয়ার ছিল যেমন আগুন, পানি এইসব আর সেদিক থেকে মা-টির ছিল সব থেকে দূর্বল পাওয়ার তা হল হার্ট। কিন্তু এই হার্টের জন্যি বাক ৪টা পাওয়ার এক সাথে কাজ করতে পারত। এই হার্ট নিজের সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে বাকী ৪ জনকে এক্সপ্রেস করতে দিত। ক্যাসের রোলও মাদ্রিদে এই রকম। তাকে বলা যায়, মাদ্রিদের ডিফেনিসভ শিল্ড আর মিডের হার্ট। আপনার হাতে যখন ক্রস মদ্রিচের মত প্লেমেকার থাকবে তখন আপনার কাজ হওয়া উচিত তাদের উপর থেকে যতটা ডিফেন্সিভ দায়িত্ব কমানো যায়। কারণ এদের পাসিং রেশিও ভয়াবহ। ক্রস মদ্রিচ দুইজনেরই পাসিং রেশিও ৯০% বা তার কাছাকাছি। কিন্তু সমস্যাটা বাধে যখন আক্রমণ করতে গিয়ে তারা উপরে উঠে যায়। বার্সার মূল আক্রমনটা হয় একচুয়েলি সেন্টারে। তার পিচের ওয়াইডটাকে ব্যবহার করে। ফলে কাউন্টার খাওয়ার সময় বল কম বেশি সেন্টার ওরিয়েন্টেডই থাকে। বুসকেটস বল সেন্টারে থাকলে ট্যাকল অথবা ইন্টারসেপ্ট করে। আর উইং থাকলে যতটা সম্ভব চেষ্টা করে আউটনাম্বার করার জন্য। কিন্তু মাদ্রিদের বেলায় হল উলটো। মাদ্রিদের মূল আক্রমণ হয় উইং দিয়ে। আর এতে যে সমস্যাটা হয় তা হল তাদের ফুলব্যাকের ফেলে আসা স্পেস বিপরীত দল কভার নিতে চায়। আবার আক্রমণ সাহায্য করার জন্য মাদ্রিদ তাদের দুই সেন্টাল মিডকেও তুলে আনে। সমস্যা হয় এরপরি। বলের পোজেশনে হারিয়ে ফেললে দেখা যায় দুই প্রান্ত হা করে আছে। এইটা একদিকে মাদ্রিদের জন্য সহজ আবার কঠিন কাজও। সহজ এই অর্থে বলা কারণ, বলা হারালেই তারা জানে পরবর্তীতে বলটা কোথায় মুভ হতে পারে আবার কঠিন হল এই পজিশনে যে কোন ভাবে আউটনাম্বার করে ফেলা যায় মাদ্রিদকে। আর এই রকম সিচুয়েশনেই ত্রাণ কর্তা হয়ে আসে ক্যাসিমিরো। ক্যাসের স্পিড, আর এত বড় স্পেস সে কভার দে। সে স্পেস ক্রিয়েট করতে পারে না তার টিমমেইটদের জন্য বুসের মত। কিন্তু সে যেইটা করতে পারে তা বুসি পারে না। সে তার টিমমেইটদের ফেলে আসা স্পেস কভার দে যেইটা বুসির পক্ষে অসম্ভব এত বড় এরিয়া কভার দেওয়া। যেহেতু বার্সা পাসিং ফুটবল খেলে তাই বুসিকে অনেক ছোট এরিয়া কভার করতে হয়। আর তার নিজের পজিশনিং সেন্সও এই ব্যাপারে তাকে অনেক সাহায্য করে। কিন্তু ক্যাসের বেলায় সেইটা না। তার কাজ এইখানে নির্দিষ্ট। আর তাই সে আউটনাম্বার হলেও ভয় নেই। কারণ ১ বনাম ১ এ বর্তমানে সে সেরা। তার অর্থ আপনি কোন ভাবে তার জন্য ১ বনাম ১ সিচুয়েশন ক্রিয়েট করতে পারলে সে যেভাবে হোক বলটা উইন করে দিবে। হয় ইন্টারসেপ্ট করে না হয় টেকনীক্যাল ফাউল করে। আর এইজন্য তার টিমমেইটদের ব্যাক লাইন নিয়ে চিনতে করতে হয় না । তারা জানে তাদের কাজগুলো ক্যাসে একাই করে দিবে। আর এইজন্য ক্যাসের স্ট্রেংথ হল তার ফিলিক্যালাটি আর অসম্ভব স্টামিনা।
এইবার আসি, এই দুইজনের আদৌ কেউ কাউকে রিপ্লেস করে নিজ নিজ ক্লাবের বিপরীতে সুট করবে কিনা। এতক্ষণ পর্যন্ত পরে আমরা যা বুঝলাম, বুসি আর্কিটেক্ট বার্সাতে আর ক্যাসে মাদ্রিদের সেভিওর। মাদ্রিদে আর্কিটেক্ট রোল প্লে করার জন্য অলরেডি দুইজন আছে তা হল ক্রুস এবং মদ্রিচ। তারমানে, আরেকজন আর্কিটেক্ট নেওয়া বিলাসিতা ছাড়া কিছু না। অন্যদিকে, বার্সার পজেশনাল ফুটবলে তারা নির্ভর করে বাকী টিমমেইটদের পজিশনের উপর। সন্দেহ নেই, এই জায়গায় যথেষ্ট লেকিং আছে ক্যাসের। তাছাড়া ক্যাসের অন্যতম দূর্বলতা হল হাইপ্রেস। তাই কোন ভাবেই সে সুট করবে না বার্সার সিস্টেমে।
স্ট্যাটঃ
বুসকেটসের ক্যারিয়ার অনেক লম্বা। সেই ২০০৯ সালে অভিষিক্ত। তার ৩বছর পর অভিষেক হয় ক্যাসেমিরোর। সো স্ট্যাট দিয়ে যাছাই করাটা এইখানে অর্থহীন। তাও বাস্তবিক একটা ধারণা নেওয়ার জন্য আমরা এইটাকে ব্যবহার করব।
ক্যাসিমিরো পার ম্যাচ ট্যাকল ৩.৬ যেখানে হাইয়েস্ট গত সিজনে ৫.৩ উচল স্টেজে। বিপরীতে, বুসকেটসের পার ম্যাচ ট্যাকল ২.৭ , যেখানে হাইয়েস্ট ৩.৮ ১০-১১ তে উচলে।
ক্যাসিমিরো পার ম্যাচ ইন্টারসেপ্ট ২, হাইয়েস্ট পোর্ত্তে থাকাকালীন ৩.৮। অন্যদিকে বুসকেটসের পার ম্যাচ ইন্টারসেপ্ট ২.১, হাইয়েস্ট ‘১০,’১১,’১২ তে।
ফাউল পার ম্যাচ ২ অন্যদিকে হল ১.১। নামটা লিখলাম না কোনটা কার বুঝে নিন।
এই পর্যন্ত ক্যাসে ১৪টা গোল আর ১০টি এসিস্ট করতে সমর্থ হয়েছে। অন্যদিকে, ৯টা গোলের বিপরীতে বুসকেটসের এসিস্ট সংখ্যা ২৬টি।
বুসের ডিস্পোসড রেইট যেইখানে .৭ ক্যাসের ওভারল এতটা খারাপ না .৮। কিন্তু ক্যারিয়ারে বুসকেটস কখনো এক সিজন বাদে কখনো ১ এর বেশি বল হারায়নি। সে দিকে ক্যাসের গত ৩ সিজনে ধরে বল হারানোর রেশিও বেড়েই যাচ্ছে .৭ ওভারল হলেও এই সিজনে সে হারিয়েছে ১.১ এর কাছাকছি।
ক্যাসেকে এই জায়গা নিয়ে অনেক কাজ করতে হবে।
তবে, বুসিকে আপনি স্ট্যাট দিয়ে জাজ করতে পারবেন না। স্ট্যাট প্রকাশ করে, আপনি কতটা পরিশ্রমী। বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ স্ট্যাটে থাকে না কিন্তু রেখে যায় সে কতটা পরিশ্রমী ছিল।বুসের খেলার ধরণ বুঝতে হলে ফুটবল ম্যাচে তার পজিশনের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে বারবার। তাকে ট্যাকল, ফাউল এই সব কম করতে হয় কারণ তার পজিশন সেন্স উত্তম। আপনি এই রকম ডিফেন্সিভ মিড শতাব্দীতে একবার পাবেন। আর এইটাই হল সব থেকে বড় সমস্যা। তাকে সহজে কাউকে দিয়ে রিপ্লেস করাতে পারবে না। দেখায় বিষয়,অবসরের পর বার্সা কিভাবে এই সমস্যা সমাধান করে। তারা এখনো জাভির রিপ্লেসমেন্ট পাইনি।অন্যদিকে, ক্যাসে হল সলিড একজন প্লেয়ার। যার উপর ভর করে বাকী ১০ জনের খেলা। আপনি কান্তে, ভিদালদের দিয়ে হয়ত ক্যাসেকে রিপ্লেস করাতে পারবেন কিন্তু ভেবে দেখুন তো তাদের কারো কি এই রকম মনস্টার স্ট্যাট আছে? এই সিজনে তার ডিফেন্সিভতা একটু দূর্বল দেখা গিয়েছে কিন্তু বিপরিতে এই সিজনে সে ৫টা গোল আর ৩টি এসিস্ট করেছে। শুধু মাত্র তার এই ফর্ম ধরে রাখলেই সে নিজেকে লোথার ম্যাথিউস, ম্যাকেলেলের মত লিজেন্ডারি ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে খুব সহজে প্রতিষ্টিত করতে পারবে। বুসকেটস নিজে একটি ধারা খুলেছে।ক্যাসেকে কোন ধারা খুলতে হবে না। তার খেলার স্টাইল পুরোপুরি হার্ডওয়ার্কের উপর নির্ভরশীল আর তার মধ্যে প্রতিভা আছে বক্স টু বক্স মিড হওয়ার।
পরিশেষে বলা যায়, বল পায়ে খেলাতে চাইলে আপনি বুসকেটসের মত কাউকে রাখবেন আর বল ছাড়া কাউকে খেলাতে চাইলে আপনার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত ক্যাসিমিরো। দুজিন পুরোপুরি ভিন্ন ধরনের প্লেয়ার। তাই তাদের মধ্যে তুলনা আসাটাই অস্বাভাবিক। বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিশ্রমের কোন তুলনা হয় না। বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মানুষ অল্প পরিশ্রমে অনেক বড় কিছু করে ফেলতে পারে। আবার যারা একটু কম ট্যালেন্ট তাদের অস্ত্র হল পরিশ্রম। পরিশ্রম দিয়ে আপনি আপনার সীমাবদ্ধতাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারেন।
লেখাটিতে মোটেও তাদের পুরো ট্যাকটিক্যাল দেখা হয়নি। বরং তুলে ধরা হয়েছে তাদের বেসিক কাঠামোটা কেমন। ১ লেখাতে দুইজনের ট্যাকটিক্যালের বিস্তারিত বর্ণনাও করা সম্ভব না।বরং লেখাটির মূল বিষয় কেন এই দুইজনের মধ্যে তুলনা সম্ভব নয়।তাই কোন ভাবে এইটাকেই তাদের ক্যারিয়ারে একমাত্র ট্যাকটিক্যাল ভেবে বিভ্রান্ত হবেন না।