তিতে ব্রিলিয়ান্স এগেইনস্ট মেক্সিকো
প্রথমে বিস্তারিত যাওয়ার আগে এই বিশ্বকাপে কিছু জিনিস আমাদের জানা উচিত। খুব খেয়াল করলে দেখা যাবে, এইবারের বিশ্বকাপে অপেক্ষাকৃত দূর্বল দলগুলো এক প্রকার বাস সিস্টেমই ব্যবহার করে শক্তিশালী দলের বিপক্ষে।আর আশা করে, তাদেরকে পিন করবে কাউন্টারে।অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী দল গুলো তখন বল পজেশনে রাখতে চায় এবং প্রতিপক্ষের এরিয়াতে স্পেস খুজতে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত না স্পেস খুজে ততক্ষণ পর্যন্ত বলটা রোটেড করেই যাচ্ছে। এতে যেইটা হয়, প্রতিপক্ষ যথেষ্ট সময় এবং সুযোগ পাই নিজেদেরকে অরগানাইজড করার জন্য। আর তাই পজেশন বেসড দলগুলোর জন্য ব্যাপারটি কঠিন হয়ে দাঁড়ায় গোল দেওয়াটা। তখন তারা যেইটা করে ম্যান ফরওয়ার্ড করতে থাকে যাতে যেভাবে হোক নিউম্যারিক্যাল সুপিরওটি সৃষ্টি করা যায় ফাইনাল থার্ডে। আর এতেই মুলত ডেডলি কাউন্টারের সুযোগ থাকে প্রতিপক্ষের। তারমানে দেখা যাচ্ছে ট্রাঞ্জিশনে আপনি ভুল করলে ভয়াবহ রকমের পানিশ্মেন্ট পেতে পারেন। আর এই ট্রাঞ্জিশন ভুলের ভয়েই স্পেন রিস্ক ফ্রি পজেশনাল খেলতে চেয়েছে। কিন্তু আপনার হাতে যদি ড্রিবলার থাকে যে ১ বনাম ১ সিচুয়েশন কিংবা ১ বনাম ২ সিচুয়েশনে ভাল তখন আপনার ম্যান ফরওয়ার্ড না করলে ও চলে। আপনাকে তখন ডিরেক্ট ফুটবল খেললেই ম্যাচটি বের হয়ে আসতে বাধ্য।
ব্রাজিল বনাম মেক্সিকো ম্যাচটি ছিল এমনই একটি ম্যাচ যেখানে তিতে এবং অসরিও ফুটবলের পুরোপুরি থিউরীটিক্যাল কনসেপ্টের উপর ফোকাস করে। ডিরেক্ট ফুটবলে কনসেপ্ট টা হল এমন,
Defense -> Transition to attack -> Attacking -> Transition to defend -> Defending.
আর এইটা একটা লুপ হোল। যেইটা পুরো ম্যাচে চলবে। এবং প্রতিটা স্টেপের নির্দিষ্ট সময় আছে। একেকটা স্টেজে আপনি ওই নির্দিষ্ট সময়ের বেশি ব্যবহার করলে আপনাকে ভুগতে হতে পারে। আমার এই লেখা ডিরেক্ট ফুটবল নিয়ে না তাই আমি এর গভীরে গেলাম না ।
মুলত এই সিস্টেম ব্যবহার করা হয় ওপেন গেইমে। যেইখানে দুই দলই চেষ্টা করে ম্যাচ বের করে আনতে। আর সিস্টেমটা সিলেক্ট করা হয় দলের ইন্ডিভিডুয়াল প্লেয়াদের স্কিলের উপর ভর করে। আর সেইজন্য মেক্সিকো তাদের এটাকিং ফরমেশনই রাখে ৪-৩-৩ তে। ডিফেন্স করার সময় থিউরীটিক্যাল ৪-৪-২ ম্যান ওরিয়েন্টেড জোনাল। নেইমার, কৌতি এমনকি ক্যাসে পর্যন্ত মার্ক । মেক্সিকো মুলত ব্রাজিলকে শেষ করতে চায় জার্মানীর মত দ্রুত ট্রাঞ্জিশন পিরিয়ড দিয়ে। কিন্তু সমস্যা হল, তিতে এই সবের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। তিতের দল ডিফেন্স অথবা এটাক দুইটাতেই বেশ কনফিডেন্স।
ম্যাচ শুরু হবার প্রথম ২০ মিনিট খুবই টেনসড সময় যায় ব্রাজিলের। ব্রাজিল এই সময় ৪-২-৩-১ এ ডিফেন্স করতে থাকে। ক্যাসের সাথে যোগ দেয় পউলিনহো।পউলিনহোর রোলটা তিতের সিস্টেমে কতটা ভাইটাল সেইটা আমরা একটু পরেই দেখতে পারব। মেক্সিকো শুরু করে হাই প্রেস দিয়ে। তার ব্যাকলাইনের উপর প্রচন্ড রকম প্রেশার সৃষ্টি করতে থাকে । আর এইজন্য মুলত প্রথম ২০ মিনিট স্পেস থাকার পরেও পউলি সেইটা ব্যবহার করে না। আর এইজন্য ব্রাজিলের পাসিং অপশন ও কমে যায়। ২০ মিনিট প্রেস করার পর। আস্তে আস্তে মেক্সিকোর এনার্জী নষ্ট হয়। এর পর শুরু হয় ব্রাজিলে শেইপ পরিবর্তন। পউলি আস্তে আস্তে উপরে উঠা শুরু করে। আর এই সময় ব্রাজিল ডিফেন্স করতে থাকে ৪-১-৪-১ এ।
এই ৪-১-৪-১ এ ব্রাজিল সুবিধা পায় দুইটা। ১। তাদের মিডের অবস্থান হয় মেক্সিকোর মিডের উপরে। তাই ট্রাঞ্জিশনের সময় কিংবা প্রেসিং সময় তারা সুবিধা পায় বেশি। ২। মিড বাই পাস হয়ে গেলেও ডিফেন্সে এনাফ ম্যান আছে রিকভারির জন্য। আর ২০-৩০ মিনিট তখন ব্রাজিল আস্তে আস্তে ডমিনেশন করতে শুরু করে। এইটা দেখে অসিও তার দলের শেইপ পরিবর্তন করে ৫-২-৩ তে চলে যায়।
যেহেতু ব্রাজিলের মিডের অবস্থান মেক্সিকোর মিডের উপরে তার উপর জায়ান্ট মিডফিল্ড এইটা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় মেক্সিকোর মিডের জন্য তাদের বাই পাস করা। তাদের হাতে অপশন থাকে মিডের উপরে লফটেড বল প্লে করা এতে সুবিধা দুইটা এক যদি ফরওয়ার্ড লাইন রিসিভ করতে পারে তাহলে তো আক্রমণ হলই। না হলে যেহেতু মিডের অবস্থান উপরে সেকেন্ড বল উইন করা যাবে। কিন্তু এর কোনটাই ব্রাজিলকে তেমন ভুগাতে পারছিল না। কারণ তাদের ডায়ানামিক মিডের জন্য। পউলির সব থেকে বড় শক্তি হল তার স্টামিনা। সে এটাকে যেমন নিউম্যারিক্যাল এডভান্টেস দিতে পারে তেমনি ডিফেন্সে ও সময়মত এসে কভার দিতে পারে। তাই কয়েকটা ছন্নছাড়া এটাক বাদে তেমন সুবিধে পাচ্ছিল না মেক্সিকো। ব্রাজিল আগে থেকেই জানত এইভাবে কাউন্তার দিতে পারে মেক্সিকো। তাই ক্যাসেকে সব সময় রেডি রাখা হত যে কোন বিপদজনক অবস্থা দেখলেই ৩ ব্যাক ডিফেন্সে শিট করতে । যেইটার জন্য ব্রাজিল সবসময় মেক্সিকোর ফরওয়াডের বিপরীতে সব সময় ২ জনকে পেয়েছে। ৩০-৩৩ মিনিট যাওয়ার পর ব্রাজিল আবার তাদের শেইপ পরিবর্তন করে।এইবার আক্রমণের সময় হয়ে যায় বল ছাড়া(লো ব্লকে) অথবা বল নিয়ে ৪-৩-৩।মানে হল, ব্রাজিল পালটা এটাক করার জন্য রেডি। মুলত এই সময় সবাই বুঝতে পারে ব্রাজিল এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল মেক্সিকোর প্লেয়ারদের ড্রেইন আউট হওয়ার জন্য। নেইমারকে এখন ফ্রী করে দেওয়া হয়।
এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, মেক্সিকোর থিউরী জার্মানীর বিপরীতে কাজে লাগলেও ব্রাজিলের বিপক্ষে লাগল না কেন। এইখানে হল ব্রাজিলের শাপে বর অবস্থা। মার্সেলোর ইনজুরী ব্রাজিলের জন্য আর্শিবাদ হয়ে আসে। জার্মানীর বিপক্ষে মেক্সিকোর সাকসেসের বড় কারণ ছিল কিমিচের ফেলে আসা স্পেস এবং তাদের মিড। কিন্তু ব্রাজিলের ফুলব্যাকরা কেউ উপরে উঠতে ইচ্ছুক না। আর তাই ফুলব্যাকদের ফেলে আসা স্পেসের যে প্ল্যানটা ছিল মেক্সিকোর সেইটা আর কার্যকর হয়ে উঠছিল না। তাছাড়া তাদের যে মিড থেকে দ্রুত ট্রাঞ্জিশন সেইটা ও হচ্ছিল না ব্রাজিলের জায়ান্ট মিডের কারণে। আর ব্রাজিল তখনো হাই পিচে ৪-১-৪-১ এ ডিফেন্ড করছিল। কারণ তিতে অলরেডি বুঝে গিয়েছিল এই ডিফেন্সিভ অরগানাইজেশন তারা ভাঙ্গতে পারছে না। আর এইজন্য বারবার ব্রাজিল ওই সময় মিড ব্যাটল উইন করছিল।
এইদিকে নেইমারকে মার্ক করে রাখায় সে তার বারবার অফ দ্যা বল মুভমেন্ট দিয়ে স্পেস ক্রিয়েট করছিল টিমমেইটদের জন্য বিশেষ করে কৌতি। কিন্তু এটাকে ফুলব্যাকদের সহযোগিতা না পাওয়ায় তেমন কোন কাজে আসছিল না তার মুভমেন্টগুলো।
প্রথম অর্ধ এইভাবে শেষ হয়। দ্বিতীয় অর্ধে তিতে তার সেকেন্ড ট্রাম্প কার্ড ফেলে মাঠে। সেইটা হল উইলিয়ানকে ফ্রী করে দেওয়া। টুর্নামেন্টে এতদিন পর্যন্ত যে কারণেই হোক উইলিয়ান কোনভাবেই আক্রমণে জয়েন করছিল না। কিন্তু ৪-৩-৩ তে এইবার তিতে তাকে ফ্রী করে দেয়। আর তাদের সার্পোট দেওয়ার জন্য উপরে উঠা শুরু করে পউলি ।এইদিকে নেইমারকে ম্যান মার্ক থেকে মুক্ত করার জন্য জেসুস নেইমার তাদের পজিশন ইন্টারচেঞ্জ করে ফেলে। এখন নেইমার হচ্ছে এটাকের মাথায়। নেইমার, উইলিয়ান কৌতি বারবার সেন্টারে এসে খেলা কন্ট্রোল নিতে চায় যেইটা দুই উইং হিউজ স্পেস প্রভাইড করতে থাকে। প্রথম গোলটি ও মোটামুটি এই রকম থিউরীটিক্যাল রুলস ফলো করে পায়। আমরা জানি, নেইমার ডায়াগোনাল রান পছন্দ করে। আর ডায়াগোনাল রান দিলে মোটামুটি ৩-৪ জন ডিফেন্ডার এমনিতে এট্রাক্ট হয়।
খুব সহজে শুধুমাত্র ইন্ডিভিডুয়াল স্কিল দিয়ে ব্রাজিল ফাইনাল থার্ডে ৪ বনাম ৪ সিচুয়েশন ক্রিয়েট করতে সমর্থ হয়। খেয়াল করলে দেখবেন। নেইমার গোল দেওয়ার পিছনে শেষ ম্যান হিসেবে ছিল পউলিনহো যে কিনা পুরোপুরি আনমার্ক। আর এটাই প্রতিপক্ষকে ভুগায়। দলের সবার আগে স্পেস খুজে পায় পউলি। আর সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে স্পেসে পৌছাতে ও পারে একমাত্র পউলি।
গোল দেওয়ার পর পরই তিতে আবার ফরমেশন পরিবর্তন করে। এইবার সিবিতে স্থায়ী ভাবে জয়েন করে ক্যাসে। আর ক্যাসের রোলটা প্লে করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় পউলিনহোকে। আর এইজন্য পউইলিনহোর জায়গায় তিতে ফার্নাকে নামায় যেইটা যুক্তিসংযত।কারণ এই কাজটা পউলির থেকে সে ভালভাবে করতে পারবে। ব্রাজিল এখন পুরোপুরি ডিফেন্সে। তারা মেক্সিকো কে আঘাত করবে কুইক ট্রাঞ্জিশনে। এই দলের মূল শক্তিই এইটা। এই সময়ে ব্রাজিলের ফরমেশন ৫-৪-১। নেইমার এখনো উপরে। ৮০ মিনিট পর আরো ড্রেইন আউট হয় মেক্সিকো। তিতে নিয়ে আসে ফিরমিনোকে। ব্রাজিলের দ্বিতীয় গোলতা ও হয় এই কুইক ট্রানজিশনের মাধ্যমে। ফার্না মিডে বল জিতে দ্রুত নেইমারকে পাস করে। আর এত প্রেসিং করার ফলে মেক্সিকো কোন প্লেয়ারই তখন সামর্থ্য ছিল না নেইমারকে আটকানোর। সেকেন্ড গোলটাও হয় প্রথম গোলের কার্বন কপি। পাথক্যটা শুধু এক জায়গায় এইবার উইলিয়ানের জায়গায় নেইমার, নেইমারের জায়গায় ববি।
ব্রাজিলের আরেকটা লক্ষ্যনীয় বিষয় ছিল সেট পিস,কর্নার কিকস। তিতে জানত মেক্সিকোর এই দলটার ও মুল শক্তি কুইক ট্রানজিশন। তাই তাদের মুল শক্তিকে শেষ করে দেওয়ার জন্য কর্নারে তারা সিলভা মিরান্ডাদের তেমন ব্যবহারই করে নি। তাদেরকে ডীফেন্সে রেখে দিয়েছে যাতে কোন ভাবে কাউন্টার করতে না পারে। উলটা শট পাস খেলে এমন অবস্থা সৃষতি করেছে যাতে লং রেঞ্জ শুটার পউলি, কৌতিরা এংগেল থেকে শট নিতে পারে। মোট কথা, তিতে সব প্লেয়ারদের শক্তি গুল নিয়েই তাদের ব্যবহার করে মেক্সিকোকে শেষ করতে চেয়েছে।
ব্রাজিলের আরেকটি দেখার বিষয় ছিল তাদের ম্যান মার্কিং। যখনই তারা দেখছে মেক্সিকোর ফরওয়াডা এগিয়ে এসেছে তারা তাকে চার্জ করেনি। উলটো ওয়েট করেছে । তাদের মিড ডিফেন্সে কভার দেওয়া পর্যন্ত মিড এসে গেলে এর পর তারা চার্জ করা শুরু করে প্লেয়ারটিকে। আর এই সময় প্লেয়ারটির হাতে অপশন থাকে সাইড পাস দেওয়ার শুধু। বলতে গেলে ব্রাজিল অপশনটা তাদের দিয়ে দেয়। কারণ সাইড পাস করতে করতে মিড এসে জয়েন করে ফেলবে ডিফেন্সের সাথে কিন্তু এই সময় পাসিং লাইন ব্লক কিংবা চার্জ করলে ড্রিবলিং অথবা থ্রু পাস দিয়ে যে কোন সময় খেলা ঘুরিতে দিতে পারত মেক্সিকো । যেইটা এই ব্রাজিল দলের গেইম ইন্টেলিজিনেসের প্রকাশ করে।
সবশেষে বলা যায়, ব্রাজিলের জন্য এইটি ভাল একটি গেইম ছিল। তারা প্রথম ২০ মিনিট নিজেদের এনার্জী সেইভ করে পরবর্তী ৬০ মিনিট এটাকের জন্য। আর এটাকের মুল ভিত্তি থাকে নেইমার। ঠিক এই সব ম্যাচেই আপনার ইণ্ডীভিডুয়াল স্কিল দরকার পড়ে। ব্রাজিল নেইমারের জন্য পারফেক্ট সিচুয়েশন ক্রিয়েট করে দিয়েছিল । আর নেইমার সুযোগের সদব্যবহার করে।